আজ আওয়ামী লীগের সম্মেলন

আজ আওয়ামী লীগের সম্মেলন

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৈরি করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। দলীয় নির্বাচনী প্রতীক- নৌকার ওপর স্থাপিত ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থের মঞ্চের পেছনে রয়েছে জাতীয় সংসদ ভবনের ছবি। মঞ্চের সামনে থেকে দেখলে যেন মনে হয়, নৌকার ওপরে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ- সেভাবেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এই মঞ্চেই আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় সম্মেলন। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটির দিনব্যাপী সম্মেলন শুরু হবে সকাল ১১টায়।

‘শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে দিনবদলের প্রত্যয়ে এগিয়ে চলছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ’- স্লোগান নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ রাজনৈতিক দলটি তার জাতীয় সম্মেলন করতে যাচ্ছে।

সম্মেলনের অনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হবে বিকেল তিনটায়। আর সবশেষে রয়েছে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কাউন্সিলর, ডেলিগেট ও আমন্ত্রিত অতিথিরা অংশ নেবেন। এবারের সম্মেলনে ৭৩টি সাংগঠনিক জেলা থেকে কাউন্সিলর হবেন ৬ হাজার ৩০০ জন।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি ২৫ হাজার জনসংখ্যায় একজন কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এর পরবর্তী ভগ্নাংশের জন্য অর্থাৎ ১২ হাজারে একজন।

আওয়ামী লীগের দফতর সূত্র জানায়, সম্মেলনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সারাদেশ থেকে কাউন্সিলরদের তালিকা এসে গেছে দলীয় কার্যালয়ে। ডেলিগেট কার্ড, পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, স্বেচ্ছাসেবক ইউনিফর্মসহ সম্মেলনের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ বিতরণও সম্পন্ন হয়েছে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে। দলের সভাপতির বক্তব্য ও সম্মেলনের ঘোষণাপত্রও প্রস্তুত হয়েছে।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় সম্মেলনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। যদিও নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা রক্ষার জন্য নিয়ম রক্ষার এ গতানুগতিক সম্মেলন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী প্রত্যেক দলের গঠনতন্ত্রে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাতীয় সম্মেলন করার বিধান হয়েছে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে প্রতি তিন বছর পর পর দলের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণে ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের গতানুগতিক একটি সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করে দলটি।

চলতি বছরের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান কমিটির মেয়াদ ৬ মাস বাড়ানো হয়েছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই দলের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

তবে অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলা এবং অর্ধেকের মতো উপজেলা সম্মেলন ছাড়াই দলের এবারের সম্মেলন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

নির্ধারিত সময়ে দলের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য নিয়ে গত বছর থেকে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলন শুরু করা হয়। কিন্তু ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়েও কিছু সম্মেলন বাকি রয়েছে বলে দলের নেতারা জানান।

সম্মেলন সফল করে তুলতে আওয়ামী লীগের ১০টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। এগুলো হলো-  অভ্যর্থনা, খাদ্য, প্রচার ও প্রকাশনা, দফতর, গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধন, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবক ও শৃঙ্খলা, স্বাস্থ, অর্থ ও সাজসজ্জা।

এসব কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দিন-রাত কাজ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্মেলনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।

ক্ষমতাসীন দলটির জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ডিজিটাল ডিসপ্লে, বিল বোর্ড, ও তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। মাইকে বাজছে মুক্তিযুদ্ধের গান।

সম্মেলনে ২ হাজার ৫০০ জন স্বেচ্ছাসেবক ১১০টি গ্রুপে ভাগ হয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। গাড়িসহ প্রবেশপথ থাকবে তিন নেতার মাজার সংলগ্ন গেট। গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে প্রবেশের প্রধান পথ টিএসসির গেট।

এছাড়া রমনা কালীমন্দির গেট, চারুকলা ইন্সটিটিউট গেট, শিশুপার্ক সংলগ্ন গেট দিয়েও প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট সংলগ্ন গেট সংরক্ষিত রাখা হয়েছে ভিআইপিদের জন্য।

এদিকে কাউন্সিলকে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বেশ কিছু রদবদল, কেন্দ্রীয় কমিটির পরিধি বাড়ানোসহ গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন গুঞ্জন শোনা গেলেও বাস্তবে কোনো পরির্তন আসছে না।

বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সর্বশেষ সভায় কমিটির পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দলের একাধিক সূত্র জানায়, সম্মেলনে বর্তমান কার্যনির্বাহী সংসদই মূলতঃ অপরিবর্তিত থাকছে। সভাপতিমণ্ডলীতে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুর পর সভাপতিমণ্ডলীর একটি পদ শূন্য রয়েছে।

দীর্ঘ ৬৩ বছরের পথ চলা এই আওয়ামী লীগের দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তারই জ্যেষ্ঠ কন্যা দু’বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দল চলছে সুদীর্ঘ ৩১ বছর ধরে।

সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। এর পর ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে।

প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মাথায় দলটির নেতৃত্বে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ বাঙালির দাবি আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়।

প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক।

১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় কাউন্সিলে সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৫ সালে তৃতীয় কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব বহাল থাকেন। ১৯৫৭ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৪ সালে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং শেখ মুজিব অপরিবর্তিত থাকেন।

১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলনে সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে সভাপতির দায়িত্বে আসেন এএইচএম কামরুজ্জামান। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন জিল্লুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসকরা রাজনীতি স্থগিত করে দেন।

১৯৭৬ সালে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হলে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় মহিউদ্দিন আহমেদ ও বর্তমান সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে।

১৯৭৭ সালে এই কমিটি ভেঙ্গে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করা হয়। ১৯৭৮ সালের সম্মেলনে সভাপতি হন আবদুল মালেক উকিল এবং সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন। দেশে ফেরার আগেই ওই বছরের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন আবদুর রাজ্জাক।

১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল গঠন করার পর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১৯৮৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন।

১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা এবং জিল্লুর রহমান দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলে একই কমিটি বহাল থাকে।

২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনা এবং আবদুল জলিল দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকেন এবং নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

অন্যান্য বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর