প্রত্যক্ষ রাজনীতির ইতি টানলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং

প্রত্যক্ষ রাজনীতির ইতি টানলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং

ভারতের রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে অবসর নিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। সেই সাঙ্গে রাজ্যসভায় তার ৩৩ বছরের দীর্ঘ সংসদীয়, রাজনৈতিক সময়ের ইতি টানলেন ৯১ বছর বয়সী এই প্রবীণ রাজনৈতিকবিদ।

প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাকে আর দেখা যাবে না।

কংগ্রেসের সিনিয়র এই নেতা ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেনি। সরাসরি রাজ্যসভায় জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মনমোহন সিং। এর আগের এমনই দুই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী এবং ইন্দর কুমার গুজরাল।

পাঞ্জাব এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নাতক তিনি। ১৯৯১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসীমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। মনমোহন যখন অর্থমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন ভারত অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে লড়াই করছিল। সে সময় ভারতীয় অর্থনীতিকে সমাজবাদী অর্থনীতি থেকে মুক্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পরিবর্তিত করার সিদ্ধান্ত নেন মনমোহন।

১৯৯১ সালের অক্টোবরে আসাম থেকে প্রথম রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১৯৯৫, ২০০১, ২০০৭ এবং ২০১৩ সালে পরপর পাঁচবার আসাম থেকে রাজ্যসভায় সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে রাজস্থান থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হন তিনি, সেই মেয়াদ শেষ হয় ২০২৪ সালের ৩ এপ্রিল।

তবে এরই মাঝে গত ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ দিল্লি আসন থেকে কংগ্রেসের হয়ে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয়ের মুখ দেখেননি তিনি। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ কেন্দ্রে বিজেপি সরকার থাকাকালীন সময়ে রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত হন তিনি।

প্রথম মেয়াদে ২০০৪ থেকে ২০০৯ এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং।

ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণের স্থপতি এবং ২০০৮ সালে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তিকে সফল রূপ দেওয়া ড. মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার দেশের অর্থনৈতিক সংকটমোচন, দরিদ্র চাষিদের ঋণ মওকুফ, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ও শিল্পমুখী অর্থনীতি এবং কর ব্যবস্থার দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করে।

ভারতের মতো একটি হিন্দু প্রধান দেশে প্রথম অহিন্দু ও শিখ ধর্মালম্বী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তার ভদ্রতা ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য পরিচিত ছিলেন। ১৯৮২ সালে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন। সেসময় ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখার্জি। স্বভাবতই প্রণব মুখার্জিকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন মনমোহন সিং। কিন্তু এরপর যখন ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ‘সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট’ (ইউপিএ) ক্ষমতায় আসে, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদে বসার পরও মুখার্জিকে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করতেন। যাতে প্রচণ্ড বিব্রত বোধ করতেন মুখার্জি। একসময় সিং’কে জোর করে ‘স্যার’ বলা বন্ধ করিয়েছিলেন তিনি।

৩৩ বছরের বর্ণময় সাংসদ জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর সাবেক কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী পি চিদাম্বরম (সেসময় ইউপিএ মন্ত্রিসভায় সিং অর্থমন্ত্রী ছিলেন) জানান, ড, মনমোহন সিং ৩৩ বছর আগে একটা মেষ শাবকের মতো রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন বুধবার(৩ এপ্রিল) রাজ্যসভার মেয়াদ শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন সাংসদ, প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে তার কাজ ও কৃতিত্ব বহু বছর ধরে সিংহের গর্জনের মতো অনুরণিত হবে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ ছিল যে আমি বহু বছর ধরে ড. মনমোহন সিং এর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।

মনমোহন সিংয়ের কর্মদক্ষতার প্রশংসা করে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের অভিমত, একটা যুগের অবসান হল। নিজের এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, মনমোহন সিং সবসময় মধ্যবিত্ত এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকদের কাছে একজন ‘হিরো’ (নায়ক) হয়ে থাকবেন। কারণ আপনি হলেন শিল্পপতি এবং উদ্যোক্তাদের একজন নেতা এবং পথপ্রদর্শক এবং আপনার অর্থনৈতিক নীতির কারণেই দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন অসংখ্য মানুষ। তিনি আরো লেখেন, আপনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পরেও, আমি আশা করবো দেশের নাগরিকদের সাথে কথা বলার মধ্যে দিয়ে আপনি জ্ঞানের শিখা প্রজ্বলিত করে রাখবেন। আমি আপনার শান্তি, স্বাস্থ্য এবং সুখ কামনা করি।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ বছরের কার্যকালের মেয়াদে একটা নড়বড়ে জোট পরিচালনা করেছিলেন সিং। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেই সেই চুক্তির বিরোধিতা করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় বামেরা। কিন্তু ২০০৯ সালে সিপিআই(এম) নেতা সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান তখন আফসোস করে ইয়েচুরিকে উদ্দেশ্য করে সিং বলেছিলেন ‘আমি আপনার পরামর্শ মিস করছি’।

রাজ্যসভা থেকে মনমোহন সিং-এর অবসর নেওয়ার পর সেই ইয়েচুরি জানিয়েছেন, রাজ্যসভায় সিং যখন বিরোধী দলনেতা ছিলেন আমি সেসময় সংসদে প্রবেশ করি। তিনি অত্যন্ত সুপঠিত এবং তার যুক্তিগুলো তথ্য এবং জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ছিল। ২০১৮ সালে নোট বাতিল হওয়ার পর আমি তখন এই ইস্যুতে সংসদে বক্তব্য রাখছিলাম। সিং তখন বলেছিলেন যে নোটবাতিলের ফলে জিডিপি ২ শতাংশ হ্রাস পাবে। পরবর্তীতে তার সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল।

মনমোহন সিং ছাড়াও ২ ও ৩ এপ্রিল একাধিক সাংসদ রাজ্যসভা থেকে অবসর নিয়েছেন। যাদের মধ্যে অন্যতম কংগ্রেসের অভিষেক মনু সিংভি, বিজেপি নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকড়, বিহারের সাবেক উপ মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা সুশীল কুমার মোদি, বিজেপির অনিল বালুনি, সমাজবাদী পার্টির জয়া বচ্চন, শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান, তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী রাজিব চন্দ্রশেখর, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ মন্ত্রী নারায়ন রানে, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভি মুরলিধরণ, রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এল মুরুগাণ প্রমুখ।

এদের মধ্যে অশ্বিনী বৈষ্ণব ও মুরুগাণকে পরবর্তী আরেকটি মেয়াদের জন্য রাজ্যসভায় পাঠাচ্ছে বিজেপি। অন্যদিকে জয়া বচ্চনকে আরেকটি মেয়াদে রাজ্যসভায় পাঠাচ্ছে সমাজবাদী পার্টি।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ খবর