পদ্মাসেতু: আবুলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ!

পদ্মাসেতু: আবুলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ!

পদ্মাসেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ শাহার ডায়েরিতে লিখে রাখা ঘুষের তালিকায় আবুলসহ পাঁচ ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। এ তালিকা ধরেই দুদক তদন্তকাজ পরিচালনা করছে। আগামী ডিসেম্বরেই আবুলসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করবে দুদকের তদন্ত কমিটি। আর মামলা দায়েরের সুপারিশসহ প্রতিবেদন লেখার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলানিউজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

রমেশের ডায়েরিতে ঘুষের তালিকায় পাওয়া পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন,  সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, পদ্মাসেতু প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী।

সূত্র জানায়, দুদকের তদন্ত টিম কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়া মাত্রই এর সারসংক্ষেপ বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে পাঠাবে। এরপরই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্যানেল ঢাকায় এসে তদন্ত টিমকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে অনুরোধ জানায়। তাদের অনুরোধ ছিল অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া মাত্রই যেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কানাডিয়ান পুলিশের তদন্তে বের হয়ে আসা এসএনসি-লাভালিনের (কানাডীয় কোম্পানি) কাছে ঘুষ দাবির তথ্যপ্রমাণও যে কোনো সময় দুদকের হাতে পৌঁছে যাবে। এর বাইরে প্রকল্পের দুর্নীতির অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা মাধ্যম থেকে এ পর্যন্ত যতটুকু তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা দিয়েও মামলার সুপারিশ করা যাবে।

পদ্মাসেতু প্রকল্পে এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে যাদের ঘুষ দিতে হবে এমন কিছু ব্যক্তির নামের তালিকা গত জুলাই মাসে পেয়েছে দুদক। বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো একটি চিঠির সঙ্গে ওই তালিকাটি পাঠানো হয়। তালিকায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি নাম সংক্ষেপে ও কয়েকটি নাম পূর্ণাঙ্গরূপে লেখা রয়েছে। সংক্ষেপে যাদের নাম লেখা রয়েছে তারা সবাই পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সূত্র জানায়, কানাডিয়ান পুলিশ তদন্তকালে এসএনসি-লাভালিনের অফিস থেকে পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজকর্ম সংক্রান্ত একটি ডায়েরি জব্দ করে। ওই ডায়েরিতে ঘুষের টাকা দাবিসংক্রান্ত একটি তালিকা পাওয়া যায়। কানাডিয়ান পুলিশ তদন্তের কিছু তথ্য-উপাত্তসহ নামের তালিকাটি বিশ্বব্যাংকে পাঠায়। বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে ওই তালিকা দুদকে পাঠিয়েছে। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তালিকায় উল্লেখ থাকা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ সম্পন্ন হয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, ওই তালিকায় প্রথমেই লেখা হয়, দাবি অনুযায়ী তাদের কিছু দিতে হবে। পরে সিরিয়াল অনুযায়ী নামগুলো লেখা হয়। কানাডিয়ান নাগরিক রমেশের ডায়েরিতে দুর্নীতির তালিকায় প্রথমে সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হয় তিন ব্যক্তির নাম। তারা হচ্ছেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও পদ্মাসেতু প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম। এরপর সম্পূর্ণ রূপে লেখা হয় সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরীর নাম।

এই তালিকার বাইরেও একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পায় দুদক।

যোগাযোগ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সন্ধ্যা ৬টায় বলেন, “আমরা যদি একটি উপসংহারে আসতে পারি যে এ প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়া মাত্রই মামলা হবে।”

এ পর্যন্ত কার কার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে—এমন প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “সেটা এখনই বলতে পারবো না। কার নামে মামলা হবে বা হবে না এ নিয়েও কিছু বলতে চাই না। আমরা চেষ্টা করছি সুষ্ঠু একটি প্রতিবেদন দিতে। এখানে দেশের স্বার্থ জড়িত।”

বাংলানিউজকে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “দুদকের অনুসন্ধান টিম এ প্রকল্পের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

গোলাম রহমান বলেন, “যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তিনি যে-ই হোন না কেন তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

জানা গেছে, কানাডায় এসএনসি-লাভালিনের তৎকালীন কর্মকর্তা রমেশ শাহা (কানাডিয়ান নাগরিক) ওই তালিকা তৈরি করেছেন। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় রমেশ শাহ ও মো. ইসমাইল হোসেনকে গ্রেফতার করেছিল সে দেশের পুলিশ। এ মুহূর্তে তারা জামিনে মুক্ত আছেন। অভিযোগটির সুষ্ঠু অনুসন্ধানের লক্ষ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে কানাডিয়ান পুলিশের তদন্ত রিপোর্টটি চেয়েছে দুদক। শিগগিরই এ তদন্ত রিপোর্টও আসছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।

জানা গেছে, পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৭০ লাখ ডলার। কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ দেওয়ার জন্য ওই তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া এসএনসি-লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে দুহাইমে ও এসএনসি-লাভালিনের অফিস থেকে জব্দ করা নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ লেনদেন বিষয়ে তথ্য পেয়েছে কানাডার পুলিশ।

সূত্র জানায়, পদ্মাসেতু প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেতে এসএনসি-লাভালিন অনিয়ম, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক থেকে কানাডা সরকারের কাছে একটি অভিযোগ জানানোর পর এ বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে। এরপর পুলিশ অতর্কিত এসএনসি-লাভালিনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ওই অফিসের কম্পিউটারসহ সব ধরনের নথিপত্র জব্দ করে। জব্দ করা নথিপত্রের মধ্যে একটি ডায়েরিতে ঘুষ দেওয়ার জন্য তৈরি ওই তালিকা পাওয়া যায়।

কানাডিয়ান পুলিশ কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংকের কাছে তাদের তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কিত তথ্য ও ঘুষ দেওয়ার জন্য এসএনসি-লাভালিনের তৈরি ওই তালিকা পাঠায়। বিশ্বব্যাংক ওইসব তথ্য ও ঘুষ দেওয়ার জন্য তৈরি তালিকাটি এরই মধ্যে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে পাঠিয়েছে।

সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের দেওয়া পরামর্শের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে দুদক টিম দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে টিম। এছাড়া নতুন করে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় তথ্য বের করার চেষ্টা করছেন কর্মকর্তারা।

এদিকে, দুদকের সিনিয়র উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদের নেতৃত্বে নতুনভাবে গঠিত চার সদস্যের অনুসন্ধান ও তদন্ত টিম সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ঘটনায় প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ করছেন। জানা গেছে, সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ আগে জিজ্ঞাসাবাদ করা ২৯ জনকে দ্বিতীয় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির কাজও শুরু করেছে টিমটি। গেল সপ্তাহ থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় টেন্ডারে অংশ নিয়ে প্রথম হওয়া কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় সাব-এজেন্ট এমএ আজিজ ও বাংলাদেশে এইকম নিউজিল্যান্ডের সাব-এজেন্ট গোলাম মোস্তফাকে।

দুদকের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানান, ১৪ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল বাংলাদেশ সফরে এসে পরপর দুই দফায় বৈঠক করে বেশ কিছু বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়। তারা এখন দুদকের কাজ পর্যবেক্ষণ করছে। ফলে দুদক সঠিক পথেই তাদের তদন্ত কাজ চালাচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানান। কেননা তাদের প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করছে এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা। পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত জুনে ঋণচুক্তি বাতিল করলেও সরকারের নানামুখী তৎপরতায় গত সেপ্টেম্বরে শর্তসাপেক্ষে এই প্রকল্পে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় সংস্থাটি।

দুদকের সিনিয়র উপপরিচালক মীর জয়নুল আবেদিন শিবলির নেতৃত্বে দুই সদস্যের তদন্ত টিম গত বছর সেপ্টেম্বরে সেতুর ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেন। তাদের প্রতিবেদন থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনকে অব্যাহতি দেওয়ায় বিশ্বব্যাংক নাখোশ হয়। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউরকে ছুটিতে পাঠানো হয়।

এদিকে, দুদকের আরেকটি সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, শেষ পর্যন্ত মামলা থেকে দুদক সরেও আসতে পারে কেননা এর আগে পদ্মাসেতুর ঠিকাদার দুর্নীতির বিষয়ে আবুলকে ‘নির্দোষ’ দাবি করেছিল দুদক।

বাংলাদেশ