1. editor@priyodesh.com : editor : Mohammad Moniruzzaman Khan
  2. monirktc@yahoo.com : স্টাফ রিপোর্টার :
  3. priyodesh@priyodesh.com : priyodesh :
শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:১৪ অপরাহ্ন

নিয়মের দাস হয়ে থেকো না: অধ্যাপক ইউনুস

Reporter Name
  • Update Time : শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১১
  • ১৯৩ Time View

তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে হয়ে গেছে ‘ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড সামিট’। পৃথিবীর ১৭০টি দেশ থেকে এ সম্মেলনে তরুণরা অংশগ্রহণ করেছে। তরুণরাই পৃথিবী বদলে দেবে এই স্লোগানকে সামনে রেখে নানা আয়োজনে হয় এ সম্মেলন। আয়োজনের অন্যতম ছিল পৃথিবীর সফল ব্যক্তিদের বক্তৃতা।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ইউনুস ‘ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড সামিট’ সম্মেলনে তরুণদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। স্বপ্নযাত্রার পাঠকদের জন্য সংক্ষেপ করে বক্তৃতাটি অনুবাদ করে দেওয়া হলো।

তোমরা সবাই জানতে পারলে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এই সম্মেলনে নিশ্চয় বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই তোমরা শুনেছ। সামনেও আমরা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলবো। আমাদের দেশে অনেক সমস্যা। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যাটা সম্পর্কে বলতে পারি যে, আমরা অন্তত এটা তৈরি করিনি। যাইহোক, সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা বলার আগে আমি বলবো, নতুন প্রজন্মের জন্য আমরা সুন্দর একটি পৃথিবী রেখে যেতে চাই। আমরা যে পৃথিবী দেখেছি; তার থেকেও সুন্দর ও নিরাপদ পৃথিবী তোমাদের হাতে তুলে দিতে চাই। যদি এটা করা যায় তাহলে হয়ত সবকিছুর সমাধান পাওয়া সম্ভব।

প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে করবো? কীভাবে নিরাপদ একটি পৃথিবী আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দেবো? আমাদের প্রজন্ম ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো তোমরা নতুনরা পারবে। তোমরা হয়তো তোমাদের পরের প্রজন্মকে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে দিতে পারবে।

আমি এবার আমার কাজের গল্প তোমাদের সাথে করবো। আমার বিশেষত্ব হচ্ছে যে কোন কাজ ছোট থেকে শুরু করা। বড় কিছু করার চেয়ে ছোট কিছু করাই আমার পছন্দ। বড় কিছু করার স্বপ্ন থাকা ভালো। কিন্তু এটা সবসময় নিজের উপর একটা ভার তৈরি করে। তুমি যদি বড় কিছু করতে যাও তাহলে খুব কম সময়েই তুমি সেখানে পৌঁছতে পারবে। কিন্তু ছোট কোনো কাজ দিয়ে শুরু করলে তোমার ভেতর সাহস থাকবে। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। আর কোনো কিছু করতে গেলে আমি সবসময় মনে করি একজন মানুষকে সঙ্গে রাখা ভালো। যদি একজন বন্ধু পাশে থাকে তাহলে দুজনের মধ্যে সমঝতা থাকে। এবং কিছু করাও যায়। সফলতা পাওয়াও সম্ভব হয়। তারপর সময় যত পার হবে, একের সাথে তুমি আরো মানুষ যোগ করতে পারো। এভাবেই আমি আমার কাজ শুরু করি।

আমি ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক শুরু করি। তখন একজনকে নিয়েই শুরু করি। আমি নিজের পকেট থেকে মাত্র ২৭ ডলার ঋণ দিয়ে শুরু করি। আবার যখন কাজটি শুরু করি তখন কাউকেই আমি এ ব্যপারে কোনো প্রশ্ন করিনি। আমি ২৭ ডলার নিয়েই সাহস পাই। আর এই ঋণটি আমি ৪২ জন মানুষকে দিই। তারপর দেখলাম এই অর্থ দিয়েই অনেকের মুখেই হাসি ফুটছে। আমি ভাবলাম, তাহলে তো কাজটা আরো বৃহৎভাবে করা যেতে পারে। এখনো আমি ঠিক ঐ কাজটিই করে যাচ্ছি। শুধু ৪২ জনের সংখ্যাটা বেড়ে গেছে। সৌভাগ্যক্রমে এ কাজটাই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমি শুরুতেই বলেছি আমি একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি কোনো ব্যাংকার নই। আমি ব্যাংকিংয়েও পড়াশোনা করিনি। ব্যাংক কীভাবে চলে সেটা সম্পর্কেও আমার কোনো ধারনা নেই। কিন্তু আমি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি। এটা সত্যিই হাস্যকর একটি বিষয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটা অসাধারণ একটি বিষয়। তুমি যদি কিছু না জানো তাহলে কিছু না জানা নিয়ে তোমার লজ্জা নেই। বরং কিছু না জানাটাই তোমার সুযোগ। তোমার তখন সৃষ্টির সুযোগ বেড়ে যায়। আমি যদি ব্যাংক সম্পর্কে জানতাম তাহলে হয়ত গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হত না। কারণ তখন আমি নিয়ম নীতি মানা শুরু করতাম। যেহেতু কিছুই জানতাম না সেহেতু আমি সব নিয়ম নীতি ভঙ্গ করতে পারছিলাম। আর এজন্য আমি মোটেও দুঃখিত নই। কারণ আমি কিছু জানতাম না।

কখনো কখনো কিছু না জানাটা আশীর্বাদের মত। কিছু জানলে মাথার মধ্যে নিয়ম নীতি ঘুরতে থাকে। এবং সেখান থেকে কেউ বের হতে পারে না।

তোমাদের কাজের শুরুটা হলো নিয়মগুলোকে ঠিক করা। কারণ এ নিয়ম নীতি যারা তৈরি করেন, তারাই অনেক বাধা তৈরি করে রাখেন। আমি আমার কাজ শুরু করি এভাবেই। শুরুতে দেখলাম নাহ তেমন কিছুই হচ্ছে না। বন্ধ করে নতুন কিছু করলাম। একবারও হতাশ হলাম না। কারণ আমি তো কিছু জানি না। নতুন ভাবনা নিয়ে মাঠে নামলাম; এবং ঐ ভাবনাটাই কাজে লেগে গেল।

আমি এমন একটা ব্যাংক দাঁড় করাতে পেরেছি যে ব্যাংকটি সাধারণ ব্যাংক থেকে ঠিক বিপরীত। সাধারণ ব্যাংক ধনীদের কাছে যায়। আমি গেলাম গরীবদের কাছে। তারা যায় পুরুষের কাছে। আমি গেলাম মহিলাদের কাছে। তারা যায় শহরে; আমি গেলাম গ্রামে। তারা বলে, তোমরা আমাদের অফিসে আসো। আমি বললাম, আমি তোমাদের মাঝে যাচ্ছি। মানুষ ব্যাংকে আসবে না; ব্যাংক যাবে মানুষের কাছে। এ কাজটাই সফল হলো। সারা বিশ্বে সফলতা পেয়ে গেলো। এখন মাইক্রোকেডিট, মাইক্রোফাইন্যান্স সবাই বোঝে।

এভাবেই গ্রামীণ ব্যাংক শুরু হলো। খুব ছোট করেই শুরু করেছিলাম। সেটাই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল।

কেন দরিদ্র মানুষ থাকবে? দারিদ্র্যতা কেন থাকবে? মানুষের মধ্যে কোনো কিছু কম আছে? দারিদ্র্যতা কখনো দরিদ্র মানুষরা তৈরি করে না। দারিদ্র্যতা তৈরি করে আমাদের ইনস্টিটিউটগুলো। যারা নিয়ম বানায় তারাই দারিদ্র্যতা তৈরি করে। দরিদ্র মানুষ হলো বনসাই গাছের মতো। বনসাই গাছ আমারা ঘরে রাখি। দেখতে খুব সুন্দর। তোমাদের কী মনে হয়? বনসাইয়ের বীজে কোনো সমস্যা আছে তাই তারা বড় হয় না? বনসাই বড় হতে পারে না কারণ সে বড় হওয়ার মতো জায়গা পায় না। তার শেঁকড় বিস্তারের জায়গা সে পায় না। তাই সে ছোট হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি গরীব মানুষ হলো বনসাই গাছ। তাদের বীজে কোন সমস্যা নেই। তারা বড় হওয়ার জন্য জায়গা পায় না। সুযোগ পায় না। তাই তারা গরীব হয়ে থাকে।

ব্যবসা মানেই আমাদের কাছে টাকা কামাতে হবে। ব্যবসায় টাকা আসবে না এটা তো ভাবাই যায় না। তোমাদের পাঠ্য পুস্তকও বলে ব্যবসায় লাভের কথা। ব্যবসার মিশন হচ্ছে প্রফিট মেক্সিমাইজেশন। পুরো বিশ্ব ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ত টাকা উপার্জনে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কী টাকা তৈরির যন্ত্র? শুধু টাকা তৈরি করার জন্যই কী মানুষ পৃথিবীতে এসেছে?

ব্যবসা সবাইকে স্বার্থপর করে তোলে। সবকিছু আমার। অন্যের জন্য কিছু না। এমন ধারণা সবার মধ্যে গড়ে ওঠে। এমন কোনো ব্যবসা কেন হয় না যে ব্যবসার লক্ষ্য হবে, সবকিছু সবার? ‘আমার কিছুই না’; এ ব্যবসাটাকেই কিন্তু বলা হয় সোশ্যাল বিজনেস।

তোমরা সবাই এখন থেকে সোশ্যাল বিজনেস নিয়ে ভাবো। ধরো, অনেকেই ড্রাগ এডিকটেড। তাদের নিয়ে কাজ করো। সেটাও একটা ব্যবসা হতে পারে। তোমাদের অনেকেই হয়তো চিন্তা করছো, কোনো ফাস্ট ফুডের দোকান দেবে। দাও। মানুষকে ভালো খাবার দিয়ে তুমি এ ব্যবসা করতে পারো। অল্প কিছু লাভসহ দরিদ্র কিছু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এটাও সোশ্যাল বিজনেস। কখনো মাথায় লাভ করার চিন্তা আনবে না। এটা যদি তোমার ভেতর থাকে তাহলে তোমার মন সংকুচিত হয়ে পড়বে।

তোমাদের হাতে অসংখ্য সুযোগ আছে। তোমরা মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে কাজ করতে পারো। তোমরা সোশ্যাল বিজনেস শুরু করতে পারো। ট্রেনিং দিয়ে অন্যর কর্মসংস্থান তৈরিতে সাহায্য করতে পারো।

এ পৃথিবী আইডিয়া দিয়ে চলে। কোনো থিউরি দিয়ে নয়। থিউরি বা নিয়ম নীতি দেখে হতাশ হয়ে পড়বে না। আমরাই এই নিয়ম তৈরি করেছি। যে কোন সময় আমরা চাইলেই এই নিয়ম ফেলে দিতে পারি। সেখানে আমাদের নিজস্ব থিউরি দেবো। ভয় পেও না। আমরা নিয়ম তৈরি করি। আমরাই নিয়ম বদলে দেই। নিয়মের দাস হয়ে থেকো না। যদি তুমি নিয়মের দাস হয়ে পড়ো তাহলে তুমি শেষ। সব আশা হারিয়ে যাবে। সব সময় নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করো। এজন্যই মানুষ পৃথিবীতে এসেছে।

সবাই বলে, সরকারের এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত। শুধু সরকার কেন করবে? নাগরিকদের দায়িত্ব সরকারের থেকেও বেশি। সারা বিশ্বে সরকারের থেকে নাগরিকরাই বেশি স্মার্ট। সবসময় কিছু করতে গেলেই সরকারকে দোষ দেই। সরকার এমন একটা সিস্টেম যা খুব দ্রুত কোনো কাজ করতে পারে না। তাদের একটা প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাদের অনেক কিছুর সাথে কম্প্রমাইজ করতে হয়। তাই সময় নেয়। কিন্তু আমরা, তোমরা অনেক স্বাধীন। আমরা দ্রুত যে কোন কিছু করতে পারি। তুমি যদি তোমার একটা ছোট্ট আইডিয়া নিয়ে এগিয়ে যাও তাহলে তুমি তোমার পৃথিবীকে মনের মত করে সাজিয়ে নিতে পারবে। অন্যের জন্যে বসে থেকো না। তুমি শুরু করে দাও। যখন তুমি মাঠে নেমে পড়বে তখন দেখবে তোমার চারিপাশে হাজারো মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং শুধু তোমরাই পৃথিবীটা বদলে দিতে পারো। তোমরাই একটি সুন্দর ও নিরাপদ পৃথিবী উপহার দিতে পারো। এগিয়ে যাও…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© ২০২৫ প্রিয়দেশ