কক্সবাজারের টেকনাফ সাবরাং এলাকার আবদুস সালাম একজন দিনমজুর। দিন এনে দিন খান। তার ৩ মেয়ে, ২ ছেলে। তিনি ছাড়া সংসারে আয়-রোজগারের আর কেউ নেই। নিজেদের অস্বচ্ছল জীবন থেকে একটু বেরিয়ে এসে সুখ প্রত্যাশী এই মানুষটি এলাকার দু’একজনের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা ধার করে দালালের মাধ্যমে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য- মালয়েশিয়া গিয়ে টাকা কামিয়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো। এ ছাড়া বাড়তি আয়ে তাদের সংসারে আর অশান্তি থাকবে না। কিন্তু সালামের সেই স্বপ্ন আর পুরণ হলো না। টেকনাফ সাগর থেকে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার অভিযোগে তাকে আটক করলো পুলিশ। এখন তিনি জেলে বন্দি।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী মানুষটি জেলে থাকায় তার ছেলে-মেয়েদের এখন দূর্বিসহ জীবন পার করতে হচ্ছে। একদিকে, পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে বাঁচা-মরার লড়াই, অন্যদিকে ঋণের বোঝা, সব মিলিয়ে দিশেহারা আবদুস সালামের পরিবার!
এভাবে কক্সবাজার জেলার হাজার-হাজার নিম্নবিত্ত মানুষ অনিশ্চিত এক জীবনের জন্য মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে কেউ আটক হচ্ছেন সাগরে, কেউ মিয়ানমারের কাছে, কেউ থাইল্যান্ডে, আবার কেউ গভীর সাগরের মাঝখানে কূল-কিনারা হারিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন।
অসমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ পথে মালয়েশিয়াগামী জেলার হাজার হাজার মানুষ এখনো গভীর সমুদ্রে অবস্থান করছেন, যারা খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর পরও সমুদ্র পাড়ে বহু মানুষ মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে অপেক্ষায় রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বৈরী আবহাওয়া কমে যাওয়ার পর পরই কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অবৈধ পথে তথা সমুদ্রপথে স্বপ্নের দেশ (!) মালয়েশিয়া যাওয়ার হিড়িক পড়ে। জেলার একটি দালাল চক্র পুরোদমে সক্রিয় হয়ে সাগর পথেই মালয়েশিয়া যাওয়ার লাভজনক মিথ্যে আশ্বাসে সাধারণ মানুষদের টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করে। এখানকার সাধারণ মানুষও জীবিকার প্রয়োজনে ওই দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে কেউ বিপদে পড়েছেন, কেউ কেউ আবার বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
গত এক সপ্তাহে এরকম শতাধিক বিদেশগামী মানুষকে আটক করেছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। আবার কাঠের তৈরি নৌকায় করে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ২ জনের সলিল সমাধিও হয়েছে।
অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার কারণে প্রতিবছর সরকার এভাবে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৩১ অক্টোবর টেকনাফের উপকূলীয় এলাকার শাপলাপুর এলাকা থেকে ২৫ জনকে আটক করে পুলিশ। এরা সবাই কাঠের তৈরি নৌকায় করে নদী পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন। এভাবে প্রতিদিন একটি দালাল চক্র সাগর পথে অবৈধভাবে গরিব মানুষদের মিথ্যে আশ্বাসে মালয়েশিয়ার নামে সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সদর, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, হ্নীলাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষদের চিহ্নিত একটি দালাল চক্র বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার নাম করে সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে যারা ধরা পড়ছেন, তারাও দালালদের নাম বলছেন না, টাকা ফেরত পাবেন না বলে!
আবার কেউ কেউ দালালের নাম বললেও কতিপয় প্রভাবশালীদের ভয়ে প্রশাসনও দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলে পুলিশ সূত্র জানায়। ফলে, বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার হিড়িক। আর এভাবে অনিশ্চিত এক জীবনের জন্য উত্তাল সাগরে পাড়ি দিচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বাংলানিউজকে জানান, পুলিশ আদম এবং দালালদের দমনে খুবই আন্তরিক। কিন্তু এটি পুলিশের একার কাজ নয়। বিশেষ করে কোস্টগার্ড এবং বিজিবিকে বিষয়টি ভালো করে দেখতে হবে।
আর তখনই এ কাজ বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।