নায়কোচিত বিদায় প্রত্যাশিতই ছিল, সেই মতোই প্রস্ত্ততি নিয়েছে শ্রীলঙ্কার বোর্ড৷ গলের বিখ্যাত স্টেডিয়ামের বাইরে হোক বা ভিতরে, চার ধারে তার ব্যানার ও পোস্টারে ছেয়ে দেওয়া হয়েছে৷ শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সফলতম ব্যাটসম্যানকে উপযুক্ত বিদায় জানাতে তৈরি অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউসের টিমও৷ আবেগের পারদ যখন তাকে নিয়ে ক্রমশ উর্ধ্বমুখী, তখন তিনি স্বয়ং কী বলছেন?
গলের প্রেস কনফারেন্স রুমে মঙ্গলবার যে কুমার সাঙ্গাকারাকে আবিষ্কার করা গেল, তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া এই উন্মাদনা থেকে তিনি অনেকটাই দূরে৷ না হলে বৃষ্টিস্নাত দুপুরে কেউ ওভাবে উইকেটে স্লেট রেখে টানা ব্যাট করে যেতে পারে? এই সাঙ্গা বিনয়ী, সংযত এবং স্মৃতিচারণে কখনও স্বপ্নসন্ধানী, কখনও মর্মাহত৷ একটা ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ না জেতার স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, আবার ২০০৯ সালে টিম বাসে জঙ্গি হানার ঘটনাকে জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বলে চিহ্নিত করেন৷ পরের প্রজন্মের সেরাদের মধ্যে বিরাট কোহলি, স্টিভ স্মিথ, জো রুট, এবি ডেভেলিয়ার্সের সঙ্গে রাখতে চান অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউসকেও৷ অকপটে বলে দেন, সচিন বা লারার মতো ব্যাটিং সৌন্দর্য বা বাঁ হাতিদের চিরাচরিত লাবণ্য তার ব্যাটিংয়ে কোনওদিন ছিল না৷ ভারত-শ্রীলঙ্কা সিরিজ শুরুর চব্বিশ ঘন্টা আগে ঠিক কী বললেন কুমার সাঙ্গাকারা? বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরাসরি শুনুন তার মুখ থেকেই:
তিনটা টেস্ট না খেলে দুটো টেস্ট খেলেই কেন বিদায় এবং ডন ব্র্যাডম্যানের টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরির (১২) রেকর্ড ছোঁয়ার হাতছানি (তার ১১টি)।
সাঙ্গাকারা: আমি ঠিক করেছিলাম, বিশ্বকাপের পরেই রিটায়ার করব৷ সেটাই মাথায় ছিল৷ কিন্ত্ত বোর্ড অফিসিয়ালদের সঙ্গে কথা বলার পরে ব্যাপারটা বদলায়৷ ঠিক হয় আরও চারটা টেস্ট খেলব৷ দুটো পাকিস্তান, দুটো ভারত৷ আরও একটা টেস্ট হয়তো খেলাই যেত, কিন্ত্ত আমি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট ছাড়ার ব্যাপারে মানসিক প্রস্ত্ততিটা নিয়ে ফেলেছি৷ শ্রীলঙ্কার ড্রেসিংরুমের দিকে যদি তাকাই, দেখি মাহেলা রিটায়ার করার পরে সিনিয়রদের মধ্যে আমি আর রঙ্গনা হেরাথই বুড়োদের দলে৷ বাকিরা সবাই ২৫-২৬৷ সেখানে আমি ৩৮৷ তখন আরও বেশি করে মনে হয়, আর থাকার মানে হয় না৷ আর রেকর্ড নিয়ে ভাবা মানেই তো যতক্ষণ সেটা না হচ্ছে, তোমাকে খেলে যেতে হবে৷ আমি তাতে বিশ্বাসী নই৷
১৩২ টেস্টে ১২৩০৫ রান, ৩৮টা টেস্ট সেঞ্চুরি৷ টেস্ট গড় এত বছর পরেও ৫৮-এর উপরে৷ এত বছরের কেরিয়ারে পিছনে তাকালে কোথাও কোনও আক্ষেপ…
সাঙ্গাকারা: কিছু জিনিস তো হলে ভালো হতো৷ একটা ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ না জিততে পারাটা বড় আফশোস৷ বরাবর মনে করেছি, বিদেশে টেস্ট সিরিজ জিততে পারাটা আসল অ্যাচিভমেন্ট৷ অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ওয়ান ডে সিরিজ জিতলেও টেস্ট সিরিজ জিততে না পারা, ভারতে গিয়ে টেস্ট সিরিজ না জেতা, বিশ্বকাপ ফাইনালে হার, এগুলো আছে৷ তবে একই সঙ্গে ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংল্যান্ডকে হারানো, লর্ডসে টেস্ট সেঞ্চুরি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়৷ এগুলো ভাবলে খুব খারাপ লাগে না৷
লাহোরে ছ’বছর আগে টিম বাসে যে জঙ্গি হানা হয়েছিল, তা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটকে কী ভাবে বদলে দেয়?
সাঙ্গাকারা: ওটা আমার কেরিয়ারে সবচেয়ে খারাপ ঘটনা কি না জানি না, তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তো বটেই৷ তবে শ্রীলঙ্কা টিমের জন্য সেটা ছিল একটা বিরাট অভিজ্ঞতা৷ দিনের শেষে ক্রিকেট তো একটা খেলাই আর আপনি যখন দেশের হয়ে কোথাও খেলেন, খুব নিরাপদেই থাকার কথা৷ সেটাই স্বাভাবিক ভাবে আমরা ধরে নিই৷ সে বার সমরবীরার পায়ে গুলি লেগেছিল, খেলা তো দূরের কথা, ও মরেও যেতে পারত৷ তার পরে দেড় মাসের মধ্যে মাঠে ফিরে টেস্ট সেঞ্চুরি করা আমাদের শিখিয়েছিল, ওই জঙ্গি হানা কখনওই শেষ কথা হতে পারে না৷ আসল কথা হল, ওটা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে মানসিক ভাবে আরও তরতাজা করে তোলা৷ ওই ঘটনা আমাদের শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের আরও কাছে এনে দিয়েছিল৷ যারা দেশের উত্তর বা উত্তর পূর্বে বছরের পর বছর রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ দেখেছেন, দেখেছেন বোমা আর সুইসাইড বম্বারদের৷ আবার বলছি, ঘটনাটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, কিন্ত্ত শেষ কথা কখনও এই ধরনের হানা হতে পারে না৷
তার পরে আজও পাকিস্তানে কোনো বড় টিম খেলতে না যাওয়াটা কিভাবে দেখেন?
সাঙ্গাকারা: যাওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে আমি মন্তব্য করার কেউ নই৷ সেটা দুদেশের বোর্ড বা নিরাপত্তার লোকেরা ঠিক করবেন৷ কিন্ত্ত পাকিস্তানের সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ আমাদের সাপোর্ট করেছেন বরাবর৷ ওই ধরনের প্রতিভা আর যোগ্যতা নিয়ে পাকিস্তান যে নিজেদের দেশের মাঠে ক্রিকেট খেলতে পারে না, সেটাও অত্যন্ত দুঃখজনক৷
কী ভাবে তাকে মনে রাখবে ক্রিকেট?
সাঙ্গাকারা: বিভিন্ন মানুষ আপনাকে বিভিন্ন কারণে মনে রাখে৷ যখন আপনি খেলেন, তখন এক ভাবে নিজেকে দেখেন৷ অবসরের পরে নিজেকে হয়তো আর একটু ভালো ভাবে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়৷ ক্রিকেটাররা সেরকমই৷ আমি শুধু যেমন ছিলাম, তেমন ভাবেই লোকের মনে থাকতে চাই৷ যে টিমম্যান ছিল, যে জিততে চাইত এবং ড্রেসিংরুমে সব কিছু শেয়ার করত৷
নিজেকে ব্যাটসম্যান হিসেবে শচিন বা লারার পাশে কোথায় রাখবেন?
সাঙ্গাকারা: এখানে একটা গল্প বলি৷ একবার আমাদের ড্রেসিংরুমে কথা হচ্ছিল, আমাদের টিমে কার ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ শট সবচেয়ে খারাপ৷ সমরবীরা আর আমি একমত হয়েছিলাম, আমারটাই টিমের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ৷ ব্যাক লিফ্ট থেকে ব্যাট সুইং, মাথা ঝোঁকানো, সবটাই খারাপ৷ ওই যে শচিন যে স্ট্রেট ড্রাইভটা মারত, আলতো পুশে বল বাউন্ডারি পেরিয়ে যেত বা লারা যে সব শর্ট আর্ম পুল মারত, ওগুলো ক্ল্যাসিক্যাল৷ সবার পক্ষে সম্ভব নয়৷ ক্ল্যাসিক্যাল বাঁ হাতি ব্যাট বলতে যা বোঝায়, যার ব্যাটিংটা দেখতে খুব ভালো লাগে, আমি মোটেও সেই জাতে পড়ি না৷ কিন্ত্ত আমার ব্যাটিংটা টিমের জন্য এফেক্টিভ বলা যায়৷ যেভাবে রান পেয়েছি, সে ভাবেই ব্যাট করেছি৷ আমার বাবা যেভাবে আমাকে শিখিয়েছিলেন৷ পরে সুনীল ফার্নান্দো আর অরবিন্দ ডি সিলভা৷ এদের কাছেও আমি চিরঋণী৷
বিশ্ব ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের ভবিষ্যৎটা কেমন দেখছেন?
সাঙ্গাকারা: আমি তো বলব, খুবই উজ্জ্বল৷ ভারতীয়দের মধ্যে যেমন বিরাট কোহলির অ্যাগ্রেসিভ স্টাইলটা আমার পছন্দ৷ ও বহু রেকর্ড ভেঙে দেবে৷ অজিঙ্ক রাহানের ব্যাটিং দেখতে বেশ লাগে৷ দারুণ ভালো টেস্ট ব্যাট৷ এরা ছাড়া স্টিভ স্মিথ, জো রুট, এবি ডেভেলিয়ার্সরা দারুণ৷ আমাদের অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউসও গত দেড় বছর ধরে টানা ভালো ব্যাটিং করে যাচ্ছে৷ যেটা হয়তো সেভাবে প্রচারিত নয়৷ রেকর্ড দেখলেই অবশ্য ব্যাপারটা বোঝা যায়৷ অ্যাঞ্জেলো শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ৷
ভারত-শ্রীলঙ্কা রাইভ্যালরি এবং চলতি সিরিজ সম্পর্কে বলুন।
সাঙ্গাকারা: অ্যাসেজ রাইভ্যালরি যেমন পরিচিত, আমাদেরটা তেমন না হলেও বরাবর এই দুই টিমের লড়াই উপভোগ্য হয়েছে৷ যেমন ওদের শেবাগ আর আমাদের জয়সুরিয়া৷ এই ব্র্যান্ডের ব্যাটিং৷ ওদের যদি শচিন, রাহুল, লক্ষ্মণ, সৌরভদের মতো ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাট থাকে তো আমাদের জবাব ছিল মার্ভন আর মাহেলা৷ ওদের-কুম্বলে হরভজন তো আমাদের মুরলী৷ স্লেজিং নয়, ঝামেলা নয়, দুর্দান্ত ক্রিকেটই ছিল সিরিজের শেষ কথা৷ এবার বিরাট যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলার কথা বলছে, সেটা আমাদের টিমেরও মডেল৷ আমি নিশ্চিত, দুর্দান্ত একটা সিরিজ হবে৷ সেখানে আমার অবসর একটা ঘটনা মাত্র৷- ওয়েবসাইট।