অপেক্ষা আর মাত্র এক বছরের। ২০১৬ সালেই বিশ্বের ধনীতম এক শতাংশের হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদের পরিমাণ বাকি ৯৯ শতাংশের মোট সম্পদের পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে। সম্প্রতি এই তথ্য উঠে এসেছে ব্রিটেনের দারিদ্র্যবিরোধী একটি দাতব্য সংস্থা অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের সমীক্ষায়। আমরা কি সত্যিই এমন একটি বিশ্বে থাকতে চাই?
বিশ্বে হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে ধনী-দরিদ্রের ফারাক। সেটি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে যে ধনী ব্যবসায়ী, অর্থনীতির নেতারা থেকে শুরু করে রাজনীতিক এবং ধর্মীয় নেতারাও আর এর থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকতে পারছেন না। তারা নিজেদের স্বার্থেই সমস্যাটির দিকে চোখ বুজে থাকতে পারছেন না।
সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, দাভোসে কো-চেয়ার হওয়ার ডাক পেয়ে আমি অবাকই হয়েছি। কারণ আমরা হলাম সমালোচকের স্বর। আমরা ক্ষমতাশালী অভিজাতদের চ্যালেঞ্জ জানাতে যাই। গতবারের এই বৈঠকে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেও হইচই ফেলেছিল অক্সফ্যাম সংস্থাটি। তারা বলেছিল, গোটা বিশ্বের মাত্র ৮৫ জন ধনীতম ব্যক্তির কাছে যা সম্পদ আছে তা বিশ্বের দরিদ্রতম ৫০শতাংশের সমান। এবছর সেই পার্থক্য আরো নিদারুণ হয়েছে। এখন মাত্র ৮০ জন মানুষের হাতে সম্পদের পরিমাণ দুনিয়ার ৩.৫ বিলিয়ন মানুষের থেকেও বেশি।
বেয়ানইয়ামার কথায়, সত্যিই কী আমরা এমন একটি দুনিয়ায় থাকতে চাই যেখানে মাত্র ১%মানুষের হাতে আমাদের সকলের থেকে বেশি সম্পদ থাকবে? তার গলাতেও গভীর উদ্বেগ যে পৃথিবীর আর সব বিষয়ের থেকেও গুরুতর হয়ে উঠছে ধনীতম এবং বাকিদের মধ্যে পার্থক্যটা। অক্সফ্যাম এক হিসেবে বলেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ধনীতম ৮০ জনের নগদ অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ভয়াবহ এক প্রবণতা হলো, যে সম্পদ তারা উত্তরাধিকার হিসেবে পাচ্ছেন সেটি তারা ব্যবহার করছেন নিজেদের সম্পদ আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে, নিজেদের স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে লবি করার উদ্দেশ্যে। ফোর্বস পত্রিকার তালিকায় থাকা ১৬৪৫ জন বিলিয়নেয়ারের মধ্যে প্রতি তিনজন তাদের ধনসম্পদের প্রায় পুরোটাই বা অংশত উত্তরাধিকার করেছেন, যাঁদের মধ্যে ২০% বিনিয়োগ করেছেন আর্থিক এবং বীমাক্ষেত্রে। এই অংশের নগদ সম্পদ ২০১৪ সালে ১২ মাসের মধ্যে বেড়েছে ১১%।
দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি স্থির করার ক্ষেত্রে এই ধনীরা কীভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে তা একটি ছোটো তথ্যেই প্রকাশ করা যাবে- শুধু ২০১৩ সালেই এই আর্থিক ক্ষেত্রটি নিজেদের হয়ে লবি করার জন্য ওয়াশিংটন এবং ব্রাসেলসে খরচ করেছিল ৫৫০ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১২ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রচারের জন্য এই ক্ষেত্র থেকে অবদান ছিল ৫৭১ মিলিয়ন ডলার।
সমীক্ষা জানিয়েছে, ২০০৯ সালেও এই সবচেয়ে ধনী অংশের হাতে ছিল বিশ্বের ৪৪ শতাংশ সম্পদ, ২০১৪ সালেই তা বেড়ে হয়েছে ৪৮ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে যা ৫০শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এই ১ শতাংশ ধনীতম গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতি প্রাপ্ত বয়স্কের সম্পদের পরিমাণ ২৭ লক্ষ ডলার (২৩ লক্ষ ইউরো)। বাকি ৫২ শতাংশ সম্পদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ রয়েছে বিশ্বের জনসংখ্যার বাকি ২০শতাংশ ধনীতমের কাছে। বিশ্বের বাকি ৮০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ৫.৫শতাংশ সম্পদ। এই অংশের জনসংখ্যার প্রতি প্রাপ্ত বয়স্কের মাথা পিছু সম্পদ হলো মাত্র ৩,৮৫১ ডলার (৩,৩৩০ ইউরো)।
পঁয়তাল্লিশ তম এই ডব্লিউ ই এফ সম্মেলনের আলোচনার মূল বিষয় হলো এই বেড়ে চলা পার্থক্য। ধনী-দরিদ্রের এই বিপুল ফারাক যে চিন্তায় ফেলেছে বিশ্বের ধনী দেশগুলির মাথাদের, সম্মেলনে উইনি বেয়ানইয়ামাকে অংশ নিতে বলার মধ্যে দিয়েই তা স্পষ্ট। ডাভোসের সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিলিয়নেয়ার বা রাজনীতিবিদরা স্পষ্টতই চাপে পড়েছেন। অক্সফ্যাম দাবি করেছে, এই সম্মেলনে তারা এই ফারাক মেটানোর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দাবি জানাবেন। এই সম্মেলনে যোগ দেবেন ৩০০-রও বেশি দেশ এবং সরকারের মাথারা।
বেড়ে চলা বৈষম্য নিয়ে আলোচনায় বসবেন জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, চীনের লি কেকিয়াং, ফ্রান্সের ফ্রাঙ্কয়েস হল্যান্ডে। আশা করা হচ্ছে এই সম্মেলনে যোগ দেবেন ইটালির মাত্তিও রেন্জি এবং মার্কিন স্বরাষ্ট্র সচিব জন কেরিও। ধনী-দরিদ্রের ফারাক বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আলোচনায় উঠে আসবে ইউরোপে সন্ত্রাসবাদী হামলা, ঠাণ্ডা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সবচেয়ে খারাপ টানাপড়েন এবং সর্বোপরি রয়েছে আবারও আর্থিক সঙ্কটের কালো ছায়া-এই সবই উঠে আসবে এই আলোচনায়। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়া, প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ এবং ইবোলার মতো সমস্যা।
বেয়ানইয়ামা জানিয়েছেন, চূড়ান্ত এই বৈষম্য কোনো দূর্ঘটনা বা কোনো অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটেনি। এটি নীতিরই ফলাফল। একে কমাতে গেলে ভিন্ন নীতিরই প্রয়োজন হবে। ক্রমাগত বেড়ে চলা বৈষম্য যে উন্নয়ন এবং সরকার পরিচালনা-দুক্ষেত্রের জন্যই খারাপ সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ব্রিটেনের আর একটি সংস্থা ইক্যুয়ালিটি ট্রাস্ট। এরা ব্রিটেনে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রচার কাজের সঙ্গে যুক্ত, সমীক্ষা করে দেখেছে যে ব্রিটেনে ২০০৮সালে ধনীতম ১০০টি পরিবারের সংযুক্ত আয় বেড়েছিল অন্তত ১৫ বিলিয়ন পাউন্ড। অথচ ঐ একই সময়পর্বের মধ্যে গড়পরতা ব্রিটেনবাসীর আয় বেড়েছিল মাত্র ১২৩৩ পাউন্ড। বর্তমানে ব্রিটেনের ৩০শতাংশ পরিবারের সম্পদের পরিমাণের সমতূল্য পরিমাণ সম্পদ রয়েছে এই ধনীতম ১০০ জনের কাছে। বস্তুত গত অর্ধ দশকে এই বৈষম্য রাজনৈতিক এজেন্ডার তালিকার অনেকটাই দখল করে আছে। পরিস্থিতি এতোটাই গুরুতর আকার নিয়েছে যে এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং পোপ। আই এম এফ-এর প্রধান ক্রিস্টিন ল্যাগার্দেও তার উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারেননি। কারণ তার মতে, এই বৈষম্যকে যদি এখনই রোধ করা না যায়, এসম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ যদি না নেওয়া যায় তবে তা আখেরে ক্ষতি করবে বিশ্বের অর্থনীতিরই। থমাস সেলিং তার সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বই ক্যাপিটালে দাবি করেছেন, সম্পদের জড়ো হওয়ার স্তরটি ১৯শতকের অবস্থায় ফিরে যাওয়া উচিত। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার গলাতেও এই আর্থিক বৈষম্যের সুর। এই বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে কর কাঠামো পুনর্গঠন করতে পারেন তিনি। সেদেশের ধনীতম ১% কাছ থেকে বাড়তি কর হিসেবে ৩০০বিলিয়ন ডলার আদায় করার কথা ভেবেছেন। যার মাধ্যমে তিনি শ্রমজীবী পরিবারগুলিকে কিছুটা সুবিধা দিতে চান। মনে করা হচ্ছে, ২০১৬সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বৈষম্যের বিষয়টি একটি বড় অংশজুড়েই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। যাকে ওমাবা নিজেই বলেছেন, মধ্যবিত্তের অর্থনীতি।
বেয়ানইয়ামা জানিয়েছেন, এই বৈঠকে তারা দুনিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলির জনগণের বার্তা পৌঁছে দিতে চান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক ব্যক্তিদের কাছে। সেই কারণে বেয়ানইয়ামা সাতদফা দাবি জানাবেন বৈঠকে। ধনী ব্যক্তি এবং কর্পোরেশনগুলি যে কর ফাঁকি দেয় তাদের ক্ষেত্রে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মতো বিশ্বায়িত বিনা ব্যয়ের মতো সাধারণ মানুষের পরিষেবায় বিনিয়োগ করা, শ্রমজীবী মানুষের উপর থেকে করের বোঝা সরিয়ে তা সম্পদশালী ব্যক্তিদের মধ্যে দেওয়া, ন্যূনতম ভাতা চালু করা মহিলাদের জন্য সম বেতন চালু করা এবং এমন অর্থনৈতিক নীতি চালু করা যাতে তারা সমান সুযোগ পান, ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা সহ দরিদ্রদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা বলয় তৈরি করা এবং বৈষম্য সামলানোর জন্য গোটা বিশ্বকে একটি লক্ষ্য স্থির করার প্রশ্নে সহমত হতে হবে-এই সব দাবি জানাবে অক্সফ্যাম। তীব্র আর্থিক বৈষম্য থাবা বসিয়েছে বাজারের গায়ে। এই বৈষম্য বাড়তে থাকলে ২০০৮-০৯সালের আর্থিক সঙ্কটের ছায়া আবারও ঘনিয়ে ওঠার অশনি সঙ্কেত জানান দিচ্ছে। তাই নিজেদের স্বার্থেই ধনী দেশগুলি এবং ধনী ব্যক্তিরা এই আকাশছোঁয়া বৈষম্য নিয়ে মাথা ঘামাতে বাধ্য হচ্ছেন আজ।