ভারতের ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ’ আকাঙক্ষা সঙ্কট প্রলম্বিত করছে

ভারতের ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ’ আকাঙক্ষা সঙ্কট প্রলম্বিত করছে

কাউসার মুমিন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে

ভারতের ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ’ আকাঙক্ষা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে প্রলম্বিত করছে। বাংলাদেশের জন-আকাঙক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে পছন্দসই সেক্যুলার শক্তিকে অগণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভারতের পরোক্ষ সমর্থন (ট্যাসিট সাপোর্ট) বাংলাদেশকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছে
যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নিয়মিত কূটনীতিতে ছন্দপতন না ঘটলেও বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থ হারাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি বাংলাদেশের জনমতের নিকট অগ্রহণযোগ্য একটি সরকারের অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনায় শুধু যে বাংলাদেশের গত দুই দশকের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অর্জনই হুমকির মুখে পড়েছে তা নয়, বরং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ সীমিতকরণ অব্যাহত থাকায় দেশটিতে উগ্রপন্থি ইসলামের উত্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাসহ এ অঞ্চলের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সঙ্কটে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বিশেষ করে গত সপ্তাহে বিরোধীদলের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতে নজিরবিহীনভাবে সরকারের বাধা প্রদান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া জানতে মানবজমিনের পক্ষ থেকে গত সপ্তাহের বিভিন্ন সময়ে মার্কিন কংগ্রেসের ‘সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশনস’ ও ‘হাউস ফরেন এফেয়ার্স কমিটি’র উঁচু পর্যায়ের কয়েকটি সূত্র এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্রের কার্যালয়ে যোগাযোগ করে সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপরোক্ত মনোভাব জানা যায়।
এদিকে ‘বাংলাদেশে যে কোনো মূল্যে সেক্যুলার শক্তিকে ক্ষমতায় রাখা না গেলে দেশটি উগ্রপন্থি ইসলামিস্টদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হবে, কিংবা বাংলাদেশের বর্তমান সরকার পুনঃনির্ববাচিত না হলে ইসলাম ঘেঁষা মধ্য ডানপন্থি রাজনৈতিক দল বিএনপির হাত ধরে মূলত উগ্রপন্থি ইসলামিস্টরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় চলে আসবে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আবারও সরব হবে এবং এ অঞ্চলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ বলে ভারতের আশঙ্কাকে যুক্তরাষ্ট্র স্রেফ ‘অতিমাত্রিক’ (ওভারব্লৌন) বলে মনে করে। এ বিষয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইতিপূর্বে প্রদত্ত বেশ কয়েকটি বিবৃতির বরাত দিয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি উঁচু পর্যায়ের সূত্র এ প্রতিনিধিকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ সঙ্কুচিত হলে উগ্রপন্থা মাথাছাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলাদেশে মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা গেলে উগ্রপন্থা নিরুৎসাহিত হবে। সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য উপায়ে নির্বাচনে কোন দল বিজয়ী হলো তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে স্থিতিশীলতার স্বার্থেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি।’ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে উগ্রবাদী ইসলামের সম্ভাব্য উত্থানের আশঙ্কা নিয়ে ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রও উদ্বিগ্ন। কিন্তু কি উপায়ে এ সম্ভাব্য উত্থান দমন করা যাবে সে বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশে মৌলবাদী ইসলাম ও জঙ্গিবাদ দমনে বর্তমান সরকারের সাফল্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ভারত এ ক্ষেত্রে বর্তমান সেক্যুলার শক্তিকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চায়। এই উদ্দেশে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেয়ে সংবিধানের আওতায় নির্বাচনকেই প্রাধান্য দিচ্ছে ভারত। অপরদিকে নির্বাচনী ফলাফলের সম্ভাব্য পরিণতির চেয়ে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকেই প্রাধান্য দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কেননা বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনীতিকে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ‘তুলনামূলক উদার’ বলে মনে করে এবং এখানে গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হলে শেষ পর্যন্ত উগ্রপন্থা উৎসাহিত হবে বলে মনে করে দেশটি। এ ছাড়া লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও মিশরের মতো উদার মুসলিম সমাজে যুক্তরাষ্ট্রের সামপ্রতিক অভিজ্ঞতা থেকেও স্টেট ডিপার্টমেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতিনির্ধারকরা আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার সঙ্কুচিত হলে উদার মুসলিম সমাজগুলোতে উগ্রপন্থি ইসলাম সহজেই ভিত্তি গড়ে তুলে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বরাবরের অবস্থান হলো, বাংলাদেশ একটি উদার মুসলিম গণতন্ত্র। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর আওয়ামী লীগের লীগ বৈঠা আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্তও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল, ‘এ দলগুলো গণতান্ত্রিক রাজনীতি করছে এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুযোগ না থাকলে এরা সহিংসতার পথ বেছে নিতে পারে।’ অপরদিকে ভারতের ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ’ আকাঙক্ষার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য নতুন নয়। এ বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতপার্থক্য সর্বপ্রথম প্রকাশ পায় ২০০৬ সালের ৬ই আগস্ট। ওইদিন নয়া দিল্লি সফররত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড বাউচারের সম্মানে প্রদত্ত লাঞ্চ বক্তৃতায় ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ই আহমেদ ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ’-এর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে সেক্যুলার শক্তিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে দেশটিতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান দমন করা সম্ভব। একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ শুধু ভারতের জনগণের স্বার্থেই নয়, বরং এ অঞ্চলের সামগ্রিক নিরাপত্তার স্বার্থেই জরুরি। এরপর ওইদিনই অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশে সেক্যুলার ফোর্স শক্তিশালী করার মাধ্যমে দেশটিতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ দমনে ভারতের প্রস্তাব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানতে চাইলে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড বাউচার বলেন, আমি মনে করে এটি (বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কা) একটি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-তাড়িত প্রচারণা (পলিটিক্যাল বাজওয়ার্ড)’… রিচার্ড বাউচার ওই সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে বাংলাদেশ উদারপন্থায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ ভালো মুসলমান, ভালো গণতন্ত্রী। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। আর এ দুটিই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।’ মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপরোক্ত অবস্থানে এখনও কোনো পরিবর্তন হয়নি। এদিকে বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান বিষয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও পেন্টাগনের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে এবং এ বিষয়ে পেন্টাগনের মতামত ভারতের অবস্থানের কাছাকাছি বলে বাংলাদেশের মিডিয়ার একটি অংশ সুকৌশলে প্রচারণা চালালেও বাস্তবে তা সত্য নয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে বাংলাদেশের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের বিষয়টি গতকালও স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংযে স্থান পেয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ অবস্থান জানতে চাইলে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি মুখপাত্র ম্যারি হর্ফ আবারও যুক্তরাষ্ট্রের হতাশা ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সংলাপ এখন আগের চেয়ে আরও বেশি জরুরি। আগামী ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র ম্যারি হার্ফ বলেন, এ বিষয়ে আমরা আগেই কোনো মন্তব্য করতে চাই না। ‘বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র দু’দিন বাকি থাকতে যুক্তরাষ্ট্র এখনও সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছে’- এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মূলত কি ধরনের বার্তা দিতে চাচ্ছে? -এমন প্রশ্নের জবাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক প্রধান মুখপাত্র মার্ক টম টেলিফোনে এ প্রতিনিধিকে বলেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানাতেই থাকবে।’ ধারণা করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে আগামী ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পরও যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান অব্যাহত রাখবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত একটি ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ’ আকাঙক্ষা করে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতা আর ভারতের উৎসাহে বাংলাদেশের মূল সংবিধানেও ‘সেক্যুলারিজম’কে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়…, ধর্মনিরপেক্ষতা যখন বাংলাদেশ সংবিধানে সংযুক্ত করা হয় তখন ভারত নিজেও সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল না… কিন্তু রাষ্ট্রকে সেক্যুলার করার নামে আবহমান কাল থেকে ধর্মীয় সমপ্রীতির পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে ধর্মের চিরায়ত ভূমিকা সরকারি উদ্যোগে নিরপেক্ষ করার প্রচেষ্টা বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময়েই হোঁচট খায়… এর ফলে বাংলাদেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে যে আওয়ামীলীগ ও ভারত ইসলাম বিদ্বেষী এবং এভাবে বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে সাধারণ মানুষের এই ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্টকে পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করলেও বাংলাদেশের জনমানসের সঠিক পাঠ করে ভারত সম্পর্কে তাদের এই ভীতি দূর করার কোনো গঠনমূলক পদক্ষেপ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কখনও লক্ষ্য করা যায়নি। উল্টো সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী ভারত ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ’ বিষয়ক তার এতদিনের ‘আকাঙক্ষা’কে বর্তমানে তার ‘অধিকার’ বলে ভাবতে শুরু করেছে। আর এ অধিকার আদায়ে আঞ্চলিক শক্তি ভারত তার নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশে যে নীতি গ্রহণ করেছে তা মূলত বাংলাদেশের জনমানসকে আরও বেশি ভারত বিরোধী করে তুলছে। এ সত্য যত দ্রুত ভারত বুঝবে তত দ্রুতই তা বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র।

অন্যান্য পাঠক মতামত