1. editor@priyodesh.com : editor : Mohammad Moniruzzaman Khan
  2. monirktc@yahoo.com : স্টাফ রিপোর্টার :
  3. priyodesh@priyodesh.com : priyodesh :
শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৯ অপরাহ্ন

জর্জ হ্যারিসন : মুক্তিযুদ্ধের ভিনদেশি কণ্ঠযোদ্ধা

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২
  • ১১৩ Time View

একাত্তরের ভয়াবহ সেই দিনগুলো। এদেশের মানুষকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা। মিলিটারিদের নির্যাতনে প্রায় এক কোটি শরণার্থীর ভারতে আশ্রয়। রক্তস্নাত বাংলার মাটিতে বাঙালির প্রতিরোধ। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। সেই দেশেই এক গায়ক শাসকদের চোখ-রাঙানি তুচ্ছ করে গেয়ে ওঠে ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ- হোয়ার সো ম্যানি পিপল আর ডায়িং ফাস্ট।

পাক হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে যখন বিরাণ বাংলার মাটি। প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয়ের জন্যে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। বিশাল শরণার্থীদের আশ্রয়ের জায়গা মিললেও অভাব দেখা দিয়েছে তাদের যথাযথ ভরণপোষণে। এর আগে ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে অসহায় অধিকাংশ বাঙালিও ছিল সে আশ্রয়স্থানে। শরণার্থীদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় সে সময়। এমন অবস্থায় শরণার্থীদের আহাকার আর আর্তনাদের সাড়া দিয়ে তাদের সাহায্যে পাশে এসে দাঁড়ায় পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত বাঙালি সেতারবাদক পন্ডিত রবি শংকর। বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে অনুরোধ করে এ শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাঙালিদের আর্তনাদকে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। অসহায়দের আকুলতার ধ্বনিকে বুকে বেধে তাদের সহায়তায় জন্যে ১৯৭১ সালে ১ আগস্ট গিটার হাতে স্টেজে উঠেন সে সময়ের মার্কিন কণ্ঠযোদ্ধা জর্জ হ্যারিসন।

‘প্রগাঢ় বেদনা চোখে নিয়ে.. বন্ধু এসে বলে আজ তার. .সাহায্য যে কতো দরকার.. যখন মৃত্যুপুরী তারই দেশ…..’ বাংলাদেশ নিয়ে এমনি এক গান লিখেছিলেন ভিনদেশি কণ্ঠযোদ্ধা জর্জ হ্যারিসন। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থা ও উদ্বাস্তুদের দুর্ভোগের উপলব্ধি করানোর জন্যেই লিয়ন রাসেনের প্রস্তাবে ‘বাংলাদেশ’ গানটি লেখেন তিনি। সে গানে তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা, চলমান গণহত্যার কথা, লক্ষ লক্ষ দেশান্তরী শরনার্থীর কথা।

কিংবদন্তি জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ না নিয়েও পরোক্ষভাবে লড়েছেন বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার্থে। বাঙালি জাতির মুক্তির দাবিতে আর্ন্তজাতিকভাবে ঐক্যমত গঠনে ১৯৭১ সালে বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়ায় ভিনদেশি এ কণ্ঠযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ১ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের মেডিসন স্কয়ারে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ কনসার্টের মাধ্যমে বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়ান তিনি।

সেতার শিখতে এসেই ১৯৬৬ সালে রবিশঙ্করের সাথে বন্ধুত্ব হয় হ্যারিসনের। বন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জর্জ হ্যারিসন আয়োজন করেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। যুদ্ধ কবলিত বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য এবং সাহায্যের হাত বাড়াতে পন্ডিত রবি শংকরের অনুপ্রেরণায় সেদিন গর্জে উঠেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য কনসার্টের প্রাপ্ত অর্থ শরণার্থীর সহযোগিতায় দান করা। নিজের তারকাখ্যাতি ও জনপ্রিয়তাকে জর্জ হ্যারিসন এই একবারই ব্যবহার করেছিলেন শুধু বাংলাদেশের জন্যে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে সে কনসার্টের স্টেজে পারফর্ম করেন বিশ্ববিখ্যাত বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল ও রিঙ্গো স্টারের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। কনসার্টে ব্যাপক সাড়া পান। বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে এ কনসার্টের অবদান ছিল অন্যতম। সে কনসার্টের প্রাপ্ত অর্থ প্রায় ২,৪৩,৪১৮.৫১ মার্কিন ডলার ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে প্রদান করা হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রতি মায়া থেকে ১৯৮২ সালে একটি মার্কিন টিভি অনুষ্ঠানে কয়েক লাখ ডলারের একটি চেক বাংলাদেশের শিশুদের উদ্দেশে তুলে দিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন।

ভিনদেশি মুক্তিযোদ্ধা জর্জ হ্যারিসন ছিলেন বিশ্ব পপসঙ্গীতের পুরোধা। ১৯৪৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বিংশ শতাব্দীর একজন কিংবদন্তি গায়ক এবং গিটারিস্ট । এ পরিচয়ের বাইরেও সঙ্গীত পরিচালক, রেকর্ড প্রযোজক এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে ছিল তাঁর বিচরণ । তিনি ছিলেন বিখ্যাত ব্যান্ড সঙ্গীত দল ‘দ্য বিটলস’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বিটলস ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। কয়েক বছরের মধ্যেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায় এ ব্যান্ডদলটি। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রাকে, সমাজ ও রাজনীতিকে নতুন স্রোতে প্রবাহিত করে দিত এ ব্যান্ডের গানগুলো। মূলত তিনি বিটলস ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। লীড গিটারিস্ট হলেও বিটলসের প্রতিটি অ্যালবামে তার নিজের লেখা ও সুর দেয়া একক গান থাকতো যা তাঁর প্রতিভার পরিচায়ক ছিল। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ’ইফ আই নিডেড সামওয়ান’, ’ট্যাক্সম্যান’, ’হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলী উইপস’, ‘হেয়ার কামস্ দ্য সান’ এবং ’সামথিং’-এর মত জনপ্রিয় সবগান। ১৯৭০ সালে ভেঙে যায় পৃথিবীখ্যাত এই ব্যান্ড দলটি। তারপরও একক শিল্পী হিসেবে জর্জ হ্যারিসনের খ্যাতি থেমে থাকেনি। ব্যক্তিগত জীবনে অন্তর্মুখী স্বভাবের জর্জ হ্যারিসন রহস্যাবৃত থাকতে বেশি ভালোবাসতেন। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এ বন্ধু দীর্ঘদিন ক্যান্সার ভুগছিলেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম এ বন্ধু ৫৮ বছর বয়সে ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান।

‘হোয়েন আই অ্যাম সিক্সটি ফোর’ গানের শিল্পী জর্জ হ্যারিসন ৬৪ বয়সটা আর পেরুতে পারেননি। অচীরেই চলে যাওয়া এ কণ্ঠযোদ্ধা গিটারের সাহায্যে অসংখ্য হৃদয় নিঙড়ে দিয়েছিলেন। তার গানের যে আকুতি তিনি প্রকাশ করে গেছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে কখনোই ভোলার নয়। এ স্মরণীয় প্রতিভার কি মৃত্যু আছে!

না, মৃত্যু তাকে কেড়ে নিলেও বাংলাদেশের মানুষ আজও তাকে স্মরণ করে পরম কৃতজ্ঞতায়। হাজার মাইল দূরে থেকে যে দেশটির জন্য সুরের আশ্চর্য ঝঙ্কারে যুদ্ধ করেছিলেন নিউইয়র্কের মেডিসন স্কোয়ারে, সেই দেশ দেখার সুযোগ আর মেলেনি তার!

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© ২০২৫ প্রিয়দেশ