ঘেঁটুপুত্র কমলা: প্রিমিয়ার শোতে গুমরে উঠে কান্না

ঘেঁটুপুত্র কমলা: প্রিমিয়ার শোতে গুমরে উঠে কান্না

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, নাটক আর চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রের মৃত্যুর ঘটনা এসেছে বহুবার। খুব সহজ-সরলভাবে জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই মৃত্যুকে তিনি উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন সময়। প্রয়াত লেখকের শেষ ছবি ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’-তেও মৃত্যুর মাধ্যমে কাহিনীর ইতি টানা হয়েছে। তবে মৃত্যু এখানে এসেছে খানিকটা অন্যভাবে। ঘেটুপুত্র কমলার অবধারিত পরিণতি যে মৃত্যু, তার জন্য দর্শকদের প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট সময় দিয়েছেন তিনি।

‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ ছবির শুভ মহরতে একে নিজের শেষ পরিচালনা হিসেবে ঘোষণা, দ্রুত শুটিং শেষ করার তাগিদ আর অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরে কাছের মানুষদের নিয়ে ছবিটি দেখার জন্য অধীর আগ্রহ– এসব কিছুর মধ্যে অনেকেই এখন খুঁজে পাচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদের চিরবিদায় নেওয়ার ইঙ্গিত। ছবিটির প্রিমিয়ার প্রদর্শনীর আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বক্তারা এসব প্রসঙ্গই উল্লেখ করেছেন বার বার।
Komala
আগামী ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ মুক্তির আগে ছবিটির প্রিমিয়ার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো ৫ সেপ্টেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় বলাকা সিনেওয়ার্ল্ডে। এটিই হুমায়ূন আহমেদের প্রথম ছবি যার প্রিমিয়ার প্রদর্শনীতে তিনি অনুপস্থিত। লেখকের সহধর্মিণী শাওন স্বাগত বক্তব্যে এ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে ছবির শুটিং চলাকালীন সময়ের কিছু স্মৃতি তুলে ধরেন দর্শকদের সামনে। দর্শকপূর্ণ বলাকা সিনেমা হলে এ সময় এক বেদনা বিধূর পরিবেশ তৈরি হয় । ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’-এর উপস্থিত কলাকুশলীদের মধ্যে কয়েকজন গুমরে কেঁদে উঠেন।

‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’-এর সাদামাটা প্রিমিয়ার শোর উদ্বোধনী পর্বে আরও বক্তব্য রাখেন ছবির প্রযোজক ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, বিশেষ অতিথি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নায়িকা ববিতা এবং ছবির অভিনয়িশল্পী ও কলাকুশলীদের কয়েকজন। হুমায়ূন আহমেদের শেষ ছবির প্রিমিয়ার দেখতে এদিন বলাকা সিনেমা হলে ভিড় করেছিলেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্পী ও কলাকুশলী।

প্রায় দেড়শ বছর আগে হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘেঁটুগান নামে নতুন সঙ্গীতধারা সৃষ্টি হয়েছিল। মেয়ের পোশাক পরে কিছু রূপবান কিশোর নাচগান করত। এদের নামই ঘেঁটু। গান হতো প্রচলিত সুরে, যেখানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রভাব ছিল স্পষ্ট। অতি জনপ্রিয় এই সঙ্গীত ধারায় নারী রূপ ধারণ করা কিশোরদের উপস্থিতির কারণেই এর মধ্যে অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে। বিত্তবানরা এইসব কিশোরকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাবার জন্যে লালায়িত হতে শুরু করেন। একসময় সামাজিকভাবে বিষয়টা স্বীকৃতি পেয়ে যায়। হাওর অঞ্চলের শৌখিনদার মানুষ জলবন্দি সময়টায় কিছুদিনের জন্যে হলেও ঘেঁটুপুত্র নিজের কাছে রাখবেন এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে বিবেচিত হতে থাকে। শৌখিনদার মানুষের স্ত্রীরা ঘেটুপুত্রকে দেখতেন সতীন হিসেবে। সমাজের একটা অন্ধকার সময়ের অনাচার-অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন হুমায়ূন আহমেদ তার শেষ ছবি ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’-তে।

অনলাইনের কিছু ব্লগে ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’-কে নিয়ে নানা বিরূপ মন্তব্য অনেকেরই চোখে পড়েছে। কিছু ব্লগে এ ছবির বিরুদ্ধে সমকামীতা তুলে ধরার প্রচেষ্টার অভিযোগ করা  হয়েছে।
komala
প্রিমিয়ার শোতে বলাকা সিনেমা হলে আমন্ত্রিত দর্শকদের সঙ্গে কিছু শিশু-কিশোরের উপস্থিতি এ জন্য ছবি শুরুর আগে অনেককেই খানিকটা বিব্রত করে। কিন্তু পুরো ছবিতে বিষয়টি তুলে ধরারে ক্ষেত্র  হুমায়ূন আহমেদ ভীষণ রুচিশীলতা আর পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়ে গেছেন। যাতে করে কোথাও বিব্রত হওয়ার অবকাশ ছিল না। বিনোদনের নামে অনাচার-অসঙ্গতি এবং তার ব্যাপক নেতিবাচক সামাজিক প্রভাব হুমায়ূন তার স্বভাবজাত সহজিয়া ও ঘরোয়া ভঙ্গিতেই ‘ঘেটুপুত্র কমলা’-তে তুলে ধরেছেন।

এ ছবির সবচেয়ে নান্দনিক দিক হলো দৃশ্যায়ন। বর্ষার টুইটুম্বর হাওরের ক্রমশ রূপবদলে চিত্র দর্শকদের মুগ্ধ করে। পানি বন্দি মানুষের চিত্ত-বিনোদনের নানা লোকাচার ছবিটিকে সমৃদ্ধ করেছে। দ্রুত শুটিং শেষের তাড়া থাকলেও ছবিটি নির্মাণে যতেœর ঘাটতি রাখেননি হুমায়ূন আহমেদ। লেখক জীবিত থাকলে দৃশ্যায়নের পুরো কৃতিত্ব অবশ্যই দিতেন ছবির চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খানকে।

ছবির শেষ দৃশ্যের আগের খানিকটা সময় ছাড়া কাহিনীর টানটান গতি কোথাও থমকে যায়নি।  সংলাপ আর রসিকতায় হুমায়ূন আহমেদ এ ছবিতেও তার অনন্য বৈশিষ্টের পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন চরিত্রের স্বতন্ত্র ভঙ্গিমায় ছেদ পড়েনি কোথাও।

‘ঘেটুপুত্র কমলা’-তে যে সবকিছু নিখুঁত-নিখাঁদ তা অবশ্য বলা যাবে না। ভিক্টোরিয়ার ছাপ মারা রূপার মুদ্রার আমলে ভাটি অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে ক্রিস্টমাস ট্রি থাকার কথা নয়। সেই আমলে আজকের মতো বোর্ড সাজানো জুয়ার প্রচলন কী ছিল? ভাস্কর্য বানাতে বার্নিশ করা কাঠ খোদাই বোধহয় কেউ করে না। তবে এসব ছোটখাট বিষয় এতোই তুচ্ছ যে, ছবির মানকে তা মোটেও প্রভাবিত করতে পারেনি।

‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ ছবিতে নায়ক বা নায়িকা হিসেবে কোনো চরিত্র নেই। প্রধান চরিত্র কমলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নৃত্যে পারদর্শী কিশোর মামুন। তার অভিনয় চলনসই হলেও অভিনয়শিল্পী হিসেবে জাত চিনিয়েছেন চৌধুরী চরিত্রে তারিক আনাম খান ও কমলার বাবা চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। প্রতিটি জায়গায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন তারা। তবে এ ছবিতে সবাইকে ছাড়িয়  সেরা অভিনয়টা করেছেন শামীমা নাজনীন।

ছবিতে আরো অভিনয় করেছেন- মুনমুন আহমেদ, আগুন, মাসুদ আখন্দ, তমালিকা কর্মকার, প্রাণ রায়, বাউলশিল্পী কুদ্দুস বয়াতী ও তার দল,  অনি, প্রাপ্তি, আইনুন নাহার পুতুল, আব্দুলাহ রানা, রফিকুল ইসলাম, এহসান এবং আরও অনেকে।

একটা নির্দিষ্ট সময়ের চালচিত্র তুলে ধরার কারণে ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ ছবিতে বৈচিত্র্যময় গান যোগ করার সুযোগ ছিল না। ঘেঁটুর গান আর কিছু লোকগানের মধ্যেই তাই এবার সীমিত থেকেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন মাকসুদ জামিল মিন্টু ও এস আই টুটুল। বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দিয়েছেন- ফজলুর রহমান বাবু, শফি মন্ডল ও প্রান্তি।
প্রিমিয়ার প্রদর্শনী শেষে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসা আমন্ত্রিত দর্শকদের অনেককেই বলতে শোনা গেছে; ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ হুমায়ূন আহমেদের কেবল শেষ ছবিই নয়, তার আটটি ছবির মধ্যে এটাই সেরা ছবি।

বিনোদন