1. editor@priyodesh.com : editor : Mohammad Moniruzzaman Khan
  2. monirktc@yahoo.com : স্টাফ রিপোর্টার :
  3. priyodesh@priyodesh.com : priyodesh :
শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১১ পূর্বাহ্ন

পারভেজ মোশাররফের ফোনে ভারতের আড়ি পাতার সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনা

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০১৯
  • ১৮ Time View

আজ থেকে দুই দশক আগে ১৯৯৯ সালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের কারগিল যুদ্ধে ৫২৭ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেও পাকিস্তান পক্ষের সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ভারতই জয়লাভ করেছিল বলে দাবি ভারতের। আজকের দিনটিকে (২৬ জুলাই) কারগিল যুদ্ধ জয়ের দিবস হিসেবেই উদযাপন করে ভারত।

কারগিল যুদ্ধের দুই দশক পূর্তিতে সেই যুদ্ধের নানা বিষয় উঠে আসছে গণমাধ্যমে। এর মধ্যে ভারতের দিল্লি থেকে বিবিসি সাংবাদিক রেহান ফজল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন কারগিল যুদ্ধে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ফোনে আড়ি পেতেছিল ভারত।

যুদ্ধের সময় সামরিক কর্মকর্তাদের কথাবার্তার গোপনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব বিষয় যদি শত্রুপক্ষের হাতে চলে যায় তাহলে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যে কোনো দেশের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঠিক তেমন বিষয়ই হয়েছিল কারগিল যুদ্ধে। পাকিস্তানি জেনারেলদের কথোপকথন চলে গিয়েছিল ভারতীয় পক্ষের হাতে। তেমনই একটি বিষয় তুলে ধরেছে বিবিসি বাংলা।

কারগিল যুদ্ধ যখন তুঙ্গে সে সময় ২৬ মে, ১৯৯৯ তারিখ রাত সাড়ে নটার সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান, জেনারেল ভেদ প্রকাশ মালিকের ঘরে ফোন বেজে উঠে। সাধারণ ফোন নয়। এই একেবারে গোপন আর নিরাপদ ফোন লাইন, ইংরেজিতে যাকে বলে সিকিওর ইন্টারনাল এক্সচেঞ্জ ফোন। সেই ফোনের অন্য প্রান্তে ছিলেন ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর এজেন্সি রিসার্চ এন্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’-এর সচিব অরভিন্দ দাভে।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি অরভিন্দ জেনারেল মালিককে বলেন, পাকিস্তানের দুই জেনারেলের মধ্যে কথোপকথন তারা রেকর্ড করেছেন। দুই জেনারেলের কথাবার্তার কিছুটা অংশ পড়েও শোনালেন মি. দাভে এবং বললেন, “এই কথোপকথনের মধ্যে বেশ কিছু গোপন তথ্য রয়েছে, যেটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।”

তবে জেনারেল মালিককে সেই ফোন করাটা ভুল ছিল। সেই ফোনের কথা মনে করে জেনারেল মালিক বিবিসিকে বলছিলেন, “দাভের এই ফোনটা আসলে করা উচিত ছিল ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সকে। কিন্তু তার সেক্রেটারি ভুল করে আমার নম্বরে ফোন করে ফেলেছিল। যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে ডি জি এম আইয়ের [সেনাবাহিনীর নিজস্ব গুপ্তচর বিভাগ] বদলে আমার কাছে ফোনটা চলে এসেছে, খুব লজ্জা পেয়েছিলেন। কিন্তু আমি বলেছিলাম ওই কথোপকথন লিখিত আকারে আমাকে খুব তাড়াতাড়ি পাঠান।”

ভারতীয় গোয়েন্দাদের রেকর্ডকৃত ফোন সম্পর্কে জেনারেল মালিক বলেন, “পুরোটা যখন আমি পড়লাম, তখন আমি আবারও অরভিন্দ দাভেকে ফোন করলাম। বলেছিলাম, আমার ধারণা এর মধ্যে একটা গলার স্বর জেনারেল মোশাররফের। তিনি সেই সময়ে চীনে ছিলেন। আর অন্য গলাটা আরেকজন খুব সিনিয়র জেনারেলের। আমি দাভেকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ওই দুটো ফোন নম্বরে আড়ি পাতা যেন বন্ধ না হয়। ‘র’ সেই কাজটা চালিয়ে গিয়েছিল।”

তিনি বলেন, “তিন দিন পরে দুই পাকিস্তানি জেনারেলের মধ্যে আবারও একটা কথোপকথন রেকর্ড করে ‘র’। কিন্তু এবার আমাকে বা ডি জি এম আইকে না পাঠিয়ে তারা ওই ফোনালাপের লিখিত বয়ান পাঠিয়ে দিল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র আর প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর কাছে।”

জেনারেল মালিক জানান, সে ঘটনার কয়েকদিন পরে ২ জুন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী আর মি. মিশ্রর সঙ্গে মুম্বাইতে নৌবাহিনীর একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন জেনারেল মালিক। ফেরার সময়ে প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ফোনে আড়ি পেতে নতুন কী তথ্য পাওয়া গেল? তখন ব্রজেশ মিশ্র বুঝতে পারলেন যে আমার কাছে পরের রেকর্ডিংগুলো লিখিতভাবে আসেনি। দিল্লিতে ফিরেই তিনি পুরো ট্রান্সস্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই একটা ঘটনাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে যুদ্ধের সময়েও নিজের দপ্তরের গুরুত্ব বজায় রাখতে গোয়েন্দা তথ্য সবাইকে না পাঠিয়ে কিছু বাছাই করা ব্যক্তির কাছে পাঠানো হচ্ছিল।

দুই পাকিস্তানি জেনারেলের মধ্যে যে কথা হয়েছিল…

আজিজ: ‘পাকিস্তান থেকে বলছি। রুম নম্বর ৮৩৩১৫-এ ফোনটা কানেক্ট করে দিন।’

মোশাররফ: ‘হ্যালো আজিজ’

আজিজ: এদিকের অবস্থা একইরকম। ওদের একটা এম আই ১৭ হেলিকপ্টার আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনি কালকের খবর শুনেছেন? মিঞা সাহেব তাঁর ভারতীয় সমকক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি ওদের জানিয়ে দিয়েছেন যে ওরাই ব্যাপারটাকে বাড়িয়ে তুলছেন। বিমানবাহিনীকে ব্যবহার করার আগে ওদের যে আরও অপেক্ষা করা উচিত ছিল, সেটাও বলেছেন। তবে উত্তেজনা কমাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরতাজ আজিজকে দিল্লিতে পাঠাতে পারেন, এই প্রস্তাবও দিয়েছেন।’

মোশাররফ: ‘আচ্ছা! এই এম আই ১৭ হেলিকপ্টারটা কি আমাদের এলাকায় ভেঙে পড়েছে?’

আজিজ: ‘না স্যার। ওদের এলাকাতেই পড়েছে। তবে আমরাই যে ওটা ধ্বংস করেছি, সেই দাবি করিনি আমরা। মুজাহিদিনদের দিয়ে দাবি করিয়েছি যেন ওরাই নামিয়েছে হেলিকপ্টারটা।’

মোশাররফ: ‘ভাল করেছ।’

আজিজ: ‘দৃশ্যটা দেখার মতো ছিল স্যার। আমার চোখের সামনে ভেঙে পড়ল ওদের হেলিকপ্টারটা।’

মোশাররফ: ‘ওয়েল ডান। এখন কি আমাদের সীমার কাছাকাছি ওদের বিমান ঘোরাঘুরি করছে? ওরা ভয় পেয়েছে কী না, সেটা বল।’

আজিজ: ‘হ্যাঁ। ওরা খুব চাপে আছে। ওদের বিমান কমই ঘুরছে এখন।’

মোশাররফ: ‘বাহ। খুব ভালো।’

কথোপকথনের টেপ নওয়াজ শরীফকে শোনানোর সিদ্ধান্ত নেয় ভারত

এরপর ১ জুন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী আর মন্ত্রীসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির সদস্যদের ওই ফোনালাপ শোনানো হয়েছিল। এ ঘটনার তিন দিন পরে ভারত সিদ্ধান্ত নিল যে ওই টেপ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে শোনানো হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠল ওই অতি সংবেদনশীল টেপ নিয়ে কে যাবে ইসলামাবাদ!

নামকরা সাংবাদিক আর কে মিশ্রকে টেপটি নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি দেওয়ার কথা হয়। তিনি তখন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন। তাকে ভারতে ফিরিয়ে এনে এই গুরুভার দেওয়া হয়। ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে যাতে তাকে তল্লাশির মুখোমুখি না হতে হয়, সেইজন্য তাকে কূটনীতিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। তার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিবেক কাটজুকেও পাঠানো হয়েছিল।

নওয়াজ শরিফের সঙ্গে দেখা করে নাশতা খেতে খেতে আর কে মিশ্র ওই টেপ শুনিয়েছিলেন আর ট্র্যান্সস্ক্রিপ্টটা তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কাজ শেষে মি. মিশ্র আর মি. কাটজু সেদিনই সন্ধ্যের মধ্যে দিল্লি ফিরে এসেছিলেন। এটা এতটাই গোপন রাখা হয়েছিল যে, ওই সময়ে এটার কথা ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায় নি।

সেই কথোপকথন শোনানোর বিষয়টি পাকিস্তানকে বাস্তবেই আঘাত করেছিল, যা পরে জানা গিয়েছিল। সে ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে ৪ জুলাই শুধুমাত্র কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ কাগজে প্রণয় শর্মা একটা খবর লিখেছিলেন। হেডলাইন ছিল ‘ডেলহি হিটস শরিফ উইথ আর্মি টেপ টক’, অর্থাৎ দিল্লি শরিফকে সেনাবাহিনীর কথোপকথন শুনিয়ে সরাসরি আঘাত করেছে।

‘র’-এর অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব বি রমন ২০০৭ সালে ‘আউটলুক’ পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন এ নিয়ে। শিরোনাম ছিল ‘কারগিল টেপ প্রকাশ করাটা কি মাস্টারস্ট্রোক হয়েছিল না বড় ভুল ছিল’! সেখানে তিনি স্পষ্টই জানিয়েছিলেন যে নওয়াজ শরীফকে কথোপকথনের রেকর্ডিংটা শুনিয়ে সেটা যেন আবার ফেরত নিয়ে আসা হয়। কোনওমতেই যেন ওই টেপ ওদের হাতে না দেওয়া হয়।

আর কে মিশ্র অবশ্য অস্বীকার করেন যে তিনি নওয়াজ শরীফকে টেপ শোনাবার কাজে যুক্ত ছিলেন। বিবেক কাটজুও কখনও জনসমক্ষে ব্যাপারটা স্বীকার করেননি।

জনসমক্ষে সেই টেপ প্রকাশ করে ভারত

পাকিস্তানে গিয়ে নওয়াজ শরীফকে ওই কথোপকথন শোনানোর এক সপ্তাহ পরে, ১১ জুন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সরতাজ আজিজের ভারত সফরে আসা ঠিক ছিল। মি. আজিজ ভারতের মাটিতে পা দেওয়ার কিছুক্ষণ আগেই ভারত একটা সংবাদ সম্মেলন করে ওই টেপ জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়। শুধু তাই নয়, সেটির কয়েকশো কপি তৈরি করে দিল্লিতে প্রতিটা বিদেশি দূতাবাসে সেই টেপ পাঠানো হয়েছিল।

কীভাবে এ কাজটি করল ভারতীয় গুপ্তচরেরা?

সে ঘটনার এত বছর পরেও ভারতীয় গুপ্তচরেরা এটা কখনও বলেন না যে কীভাবে ওই ফোনালাপে আড়ি পাতা হয়েছিল। পাকিস্তানিরা মনে করেন এর পেছনে সিআইএ অথবা মোসাদের সাহায্য পেয়েছিল ভারত। যারা ওই টেপ শুনেছেন, তাদের সবারই মনে হয়েছে যে ইসলামাবাদের দিক থেকে কথা অনেক স্পষ্ট। তাই সম্ভবত ইসলামাবাদ থেকেই আড়ি পাতা হয়েছিল।

পাকিস্তানি সাংবাদিক নাসিম জাহেজার লেখা বই ‘ফ্রম কারগিল টু দা ক্যু’ বইতে তিনি লিখেছেন, “নিজের চিফ অফ স্টাফের সঙ্গে সাধারণ টেলিফোন লাইনে এত সংবেদনশীল কথাবার্তা বলে জেনারেল মোশাররফ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে তিনি কতদূর বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন। ওই ফোনালাপেই প্রমাণ হয়ে যায় যে, কারগিল অপারেশনে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্বের কতটা মদত ছিল।”

জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আত্মজীবনী ‘ইন দা লাইন অফ ফায়ার’-এ এই টেপ-কাণ্ডের কোনো উল্লেখই করেননি তিনি। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার পরে ভারতীয় সম্পাদক এম জে আকবরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই টেপের কথা তিনি স্বীকার করে নেন।

সেই রেকর্ড প্রকাশের পরেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরতাজ আজিজ দিল্লিতে

নওয়াজ শরীফকে কথোপকথনের রেকর্ড শোনানোর এক সপ্তাহ পরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরতাজ আজিজ দিল্লি গিয়েছিলেন। পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস সচিব বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বিমানবন্দরের ভি আই পি লাউঞ্জে ঘোরাঘুরি করছিলেন সেদিন। তাঁর হাতে অন্তত ৬টা ভারতীয় খবরের কাগজ ছিল, যেগুলোতে মোশাররফ-আজিজ কথোপকথনের খবরটা শীর্ষ শিরোনাম হিসাবে ছাপা হয়েছিল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিং বেশ শীতলভাবেই হাত মিলিয়েছিলেন মি. আজিজের সঙ্গে।

গুরুত্বপূর্ণ ওই টেপটিই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এর মাধ্যমেই সারা বিশ্বের কাছে প্রমাণিত হয়েছিল যে, কারগিলের ঘটনায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি হাত ছিল না আর তার সেনাবাহিনী কারগিল অভিযানের বিষয় গোপন করে রেখেছিল।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© ২০২৫ প্রিয়দেশ