1. editor@priyodesh.com : editor : Mohammad Moniruzzaman Khan
  2. monirktc@yahoo.com : স্টাফ রিপোর্টার :
  3. priyodesh@priyodesh.com : priyodesh :
সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৭ অপরাহ্ন

২৫ ফেব্রুয়ারি: যেদিন শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারায় দেশ

Reporter Name
  • Update Time : শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২
  • ৯৪ Time View

পড়ার ঘরসহ পুরো বাড়িজুড়ে তাঁর চিরাচরিত উজ্জ্বল বিচরণ আমার চোখে চিরভাস্বর হয়ে আছে। আমার বড় ভাই শহীদ কর্নেল মুজিবের কথা বলছি, তাঁর চিত্তহারী আচরণ আমার মতো অনেকের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর অনেক তরুণ সহকর্মী আমাকে বলেছেন তিনি কত গভীরভাবে তাঁদের সবার জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেদিনই তাঁর এক সহকর্মী বললেন, “আমাদের প্রতি স্যারের সম্মানবোধ ও যতœশীলতা ছিল এমন, তাঁর সঙ্গে কথা বললে নিজেকে অনেক বড় মনে হতো, মনে হতো আকাশছোঁয়ার জন্য আমাদের জন্ম।” তাঁর আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে বিমোহিত ও মুগ্ধ করত। আমি তাঁর কাছেই দেশপ্রেম শিখেছি। শুধু কর্নেল মুজিবই নন, আমাদের ৫৭ জন বীর সেনানী শহীদ ভাইয়েরে, যারা ছিলেন জাতরি শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাঁরা তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, আমাদের দেশপ্রেম শিখিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের অনেককেই চিনতাম। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন আকর্ষণীয়, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সুদর্শন। বহুবার কথা বলেছি জেনারেল শাকিল, কর্নেল নকিব, কর্নেল আফতাব, লে. কর্নেল আজম, লে. কর্নেল লুৎফর, মেজর সালেহ, মেজর হাকিম, মেজর মাহমুদ, মেজর হাসানসহ আরো অনেকের সাথে। জীবনের প্রতি তাঁদের অপরিসীম উদ্যমতা ও তৃপ্তিবোধ এবং দেশের প্রতি ভালবাসা আমাকে বিস্মিত করত। আমি আজও অনুভব করি তাঁদের সাহসী পদচারণা। তাঁরা সবাই মহৎ হৃদয়, উদার ও খোলা মন নিয়ে এক আলোকিত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন।

সেদিন রাতে, ২৪ ফেব্রুয়ারি, আমি কর্নেল মুজিবের সাথে শেষবারের মতো কথা বলি। সেদিন সকালের ঈর্ষণীয় এক কুচকাওয়াজের নেতৃত্বের জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম কাল কথা হবে, আর কথা হয় নি, নরপিশাচদের তাণ্ডবলীলা নিয়ে গেছে তাঁকে অনেক দূরে। যখন আমি জানলাম তিনি অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, বুক ভারি হয়ে উঠল, হৃদয়ে তীব্র রক্তক্ষরণ নিয়ে ছুটে গেলাম বিডিআর গেটের সামনে, কারও সাথেই যোগাযোগ করা গেল না। দুর্বৃত্তরা এই বীরদের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা দেখাল না। এই কালো দিনটিতে আমি সব হারালাম, আমার ভাই, বন্ধু, পথনির্দেশক, শিক্ষক, অভিভাবক, শক্তি, সাহস সবই। ভেবেছিলাম এই শোক থেকে বুঝি আর উঠে দাঁড়াতে পারব না আমি, ক্রমশ নিথর হয়ে যাব আমিও, কিন্তু না সহসাই উঠে দাঁড়িয়েছি আমি। আর এই সক্ষমতাও পেয়েছি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে, তিনি যে ছিলেন শক্তির প্রতীক, জীবন দিয়েও তিনি তাই প্রমাণ করে গেছেন।

সেই ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির কালো দিনে ওই দুর্বৃত্তদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা এই সব বীর শহীদের, আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমকে বিন্দুমাত্র ক্ষুণœ করতে পারেনি। সেদিন পুরো জাতি এই বীরদের হারানোর শোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। এই নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যে গভীর বেদনা ও অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি হয়েছে তা উপশমের জন্য আমাদের পথ খুঁজতে হবে। এইসব বীর শহীদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও তাদের স্মরণ আমাদের ক্ষতকে কিছুটা হলেও সারাবে। তবে তাদের জীবনাদর্শ ও দেশপ্রেম থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা উজ্জীবিত হতে পারলেই তারা বেশি খুশি হবেন। শহীদ বীরেরা আমাদের জন্য রেখে গেছেন মহানুভবতা ও আত্মত্যাগের এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত, যা আমাদের সামনে চলার পথে অনুপ্রেরণা জোগাবে। তাদের কাছ থেকে আমরা শিখেছি দেশপ্রেম আর উচ্চতর মানবিক মর্যাদার এক অনন্য নির্দশন, যা সাম্প্রতিক সময়ে কেউই আমাদের শেখাতে পারেনি। এ রকম একদল সাহসী ও দেশপ্রেমী মানুষের সাহচর্য পাওয়া আমাদের জীবনে একটি চমকপ্রদ উপহার।

দুর্ঘটনার ৩ বছর পার হয়ে গেল। শহীদদের প্রিয়জন, তাদের স্ত্রী, সন্তান, বাবা, মা, ভাই, বোন ও বন্ধুদের সাথে কথা হয়েছে আমার। তারা সবাই একই কথা বলেছেন “ওই দিনটি, যেদিন দেশ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারিয়েছে, আমাদের জীবনকেও এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। আমরা কোনোদিনও তাদের অবদানরে কথা ভুলব না।” আমরা ভুলে যাব না যে আমরা একধারে সৌভাগ্যবান মানুষও বটে কারণ আমাদের জীবদ্দশায় আমরা এসব চমৎকার ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়েছি। মাতৃভূমি থেকে আজ আমি অনেক দূরে, দূরে থাকার শক্তিও পেয়েছি আমি শহীদ কর্নেল মুজিবের কাছ থেকে। প্রয়োজন শেষে আমি দ্রুত ফিরে আসব দেশে যেখানে আমার ভাই শুয়ে আছে চিরনিদ্রায় তার সহকর্মীদের সাথে।

আমার ভাইয়েরা, শহীদ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁরা বারবার তাঁদের চারিত্রিক সুদৃঢ়তা ও সাহসিকতার প্রমাণ রেখেছেন; বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। তাঁদের শক্তি ও অধ্যবসায় আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। মাতৃভূমির সেবায় ও রক্ষায় নিয়োজিত থেকে তাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। হন্তারক, নরপশুদের বিচারের মুখোমুখি এনে যথাযোগ্য শাস্তি দিতে পারলেই বীর শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের একটি কাজের সমাধান হবে। “শহীদ ভাইয়েরা, তোমরা সবাই আমাদের মনের মণিকোঠায় থাকবে চিরকাল। তোমাদের মাতৃভূমি ছাড়াও সুদূর কানাডাতে তোমাদের বন্ধুবান্ধব ও সুহৃদরা বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে তোমাদের স্মরণ করছে।”

আমাদের এই বীর শহীদরা দেশপ্রেমের যে শিখা জ্বালিয়ে গেছেন, আমাদের যুবসমাজ, আমি আশা করি, সে শিখায় আলোকিত হবে। শহীদদের জীবনাদর্শ থেকে আমাদের যুবসমাজ অবশ্যই এই শিক্ষা নেবে যে নিজের স্বার্থ নয়, দেশের সম্মান ও স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু নেই।

সরকার ও সুশীল সমাজসহ আমরা সবাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, আমরা শহীদ বীরদের কখনো ভুলব না এবং জাতি হিসেবে আমরা তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেব। আজ সময় এসেছে নিজেকে প্রশ্ন করবার, কী করেছি আমরা তাঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখবার জন্যে, তাদের সম্মানার্থে? প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের প্রতিশ্রুতি। আজ এই শহীদ সেনা দিবসে আরো একবার তোমাদের বলছি “হে বীর সেনানীরা, জাতি যথাযথ মর্যাদায় এই দিনটিকে পালন করবে, তোমাদের স্মৃতি জাগরুক রাখবার জন্য প্রস্তাবিত স্মৃতিস্তম্ভ হবে, সম্মানে জাতি মাথা নোয়াবে তোমাদের স্মরণ করে।”

প্রিয় শহীদ ভাইয়েরা, তোমরা আমাদের জন্য উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো, যা অন্ধকার আকাশে পথচলার দিক-নির্দেশক। আমরা বার বার তোমাদের কাছে ফিরে আসব শক্তি ও দিক-নির্দেশনার জন্য। ২৫ ফেব্রুয়ারির এই দিনে আমরা অশ্রুসিক্ত নয়ন ও কৃতজ্ঞচিত্তে তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© ২০২৫ প্রিয়দেশ