বিবিসি সংলাপ : ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে সেনাশাসন আসতে পারে’

বিবিসি সংলাপ : ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে সেনাশাসন আসতে পারে’

চলমান পরিস্থিতিতে সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে সামরিক শাসন আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিবিসি সংলাপে অংশ নেওয়া বক্তা ও দর্শকরা।

তবে দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক না চাইলে সামরিক শাসন আসবে না এমন কথাও এসেছে সংলাপে। এছাড়া, দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বিবিসি সংলাপের দর্শক ও বক্তারা।

সংলাপে অংশগ্রহণকারী কেউ কেউ বলেন, “পুলিশ প্রাথমিক ধাপ না মেনেই সরাসরি গুলি করছে। এটা বন্ধ করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আর এটার সুযোগ নিতে পারে তৃতীয় কোন পক্ষ।”

শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিএম অডিটোরিয়ামে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে অংশ নিয়ে প্যানেল ও বক্তারা এসব মতামত তুলে ধরেন।

বিবিসি সংবাদদাতা আকবর হোসেনের সঞ্চালনায় সংলাপের প্যানেলে ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জে. (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রফেসর মোশাহিদা সুলতানা।

সংলাপে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামরিক হস্তক্ষেপের পথকে প্রসারিত করবে কী না- কাবিয়ুল ইসলাম নামে একজন অংশগ্রহণকারীর প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক আমিন আহমেদ বলেন, “আমার মনে হচ্ছে না। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নির্ভর করছে। তবে, এটা ঠিক দেশ আজ ক্রান্তিকাল পার করছে। বর্তমানে দেশে দু’ভাগে বিভক্ত। ইসলামী ও যুদ্ধাপরাধী পক্ষ অন্যটি সরকার পক্ষ। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী কখনও চাইবে না অন্যের দোষ নিজের কাধে নিতে।”

তিনি বলেন, “সরকার দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করবে। এর আগেই যদি সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে তবে তা হবে যড়যন্ত্র। যা দেশের জনগণ মানবে না।”

ঢাবি শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, “সামরিক শাসক আসা উচিত হবে না। আমার মনে হয় শাহবাগের আন্দোলনে সামরিক সরকার দাড়াঁতে পারবে না। পরিস্থিত সমাধান করতে জামায়াতকে বুঝতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে মসজিদ ও মন্দিরে হামলা হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “জামায়াতকে বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কী ধর্মের দিকে যাবো নাকি স্বাধীনতার দিকে যাবো।”

এ সময় একজন দর্শক আমির হোসেন আমু’র কাছে জানতে চান, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে দেশ ও বিদেশে প্রতিদিনই যড়যন্ত্র হচ্ছে। এমতাবস্থায় দেশে গৃহযুদ্ধ হলে আপনাদের পরিকল্পনা কী?”

জবাবে আমির হোসেন আমু বলেন, “আসলেই যড়যন্ত্র হচ্ছে। এ ধরণের যড়যন্ত্র স্বাধীনতার সময়ও হয়েছে, তবু আমরা জয়ী হয়েছি। এখনও যে যড়যন্ত্র হচ্ছে তা মোকাবেলায় সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, “যদি দেশের আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের কাছে থাকে এবং সরকার যদি সেনাবাহিনী তলব না করে তবে সামরিক সরকার বা হস্তক্ষেপ হবে না।”

তবে দর্শকের কেউ কেউ বলেন, “দেশের বিদ্যামান পরিস্থিতি সামরিক সরকার ডেকে আনবে।”

বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, “বাংলাদেশ সত্যিই উত্তাল সময় পার করছে। এ পরিস্থিতিতে আমি বিচলিত, উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত। একদিনে ৬০ থেকে ৭০ জন মানুষ হত্যা স্বাধীনতার পর আর কখনও ঘটেনি।”

তিনি বলেন, “দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান আগামী নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা তৈরি করেছে। কারণ, সরকার একচেটিয়াভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছে। আর বিরোধী দলও সরকারি দলের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা তৈরি হয়েছে তাতে ভিন্ন উপায়ে সামরিক শাসন আসতে পারে।”

তার প্রতিউত্তরে আমু বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বর্তমানে অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক।”

আমু দাবি করেন, “দলীয় সরকারের অধীনেই দেশের অনেক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।”

তার এ কথার জবাবে রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, “জাতীয় নির্বাচনে সরকার বদল হয়, স্থানীয় নির্বাচনে সরকার বদল হয় না। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের ওপর দেশের মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না।”

সাম্প্রতিক আন্দোলনে পুলিশ কি নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারছে? এমন প্রশ্নের জবাবে অনেক দর্শক পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, “সরকার একদিকে পুলিশের সহায়তায় আন্দোলন করাচ্ছে, অন্যদিকে পুলিশ দিয়ে গুলি করাছে।”

বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া দাবি করেন, “আবারো গণহত্যা চলছে। পুলিশের দলীয়করণ করার ফলে এটি হচ্ছে।”

তিনি আরও দাবি করেন, “জামায়াত পুলিশকে কখনও টার্গেট করে না। এর প্রমাণ মতিঝিলের সমাবেশে পুলিশকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছে তারা।”

রফিকুল বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে ভিন্ন ব্যবস্থায় পুলিশ অ্যাকশনে যেতে পারতো। প্রথমে গরম পানি, টেয়ারশেল, কেমিক্যাল ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারতো। কিন্তু তা না করে ‍তারা সরাসরি গুলি করছে। সর্বোপরি আন্দোলন দমনে পুলিশের প্রশিক্ষণ দরকার।”

আমির হোসেন আমু বলেন, “দেশের সার্বিক ঘটনায় কেউ অবিচারের শিকার হলে এর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। নিরপরাধ মানুষ মারা গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার।”

ইসলাম ও স্বাধীনতাকে সরকার পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে কি না- একজন দর্শকের এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামীলীগ নেতা আমু বলেন, “মোটেই না। কারণ দেশে স্বাধীনতার পর ইসলাম প্রচারে বঙ্গবন্ধু অবদান রেখেছেন। বর্তমান সরকারও তা করছে।”

অন্য দিকে রফিক‍ুল ইসলাম মিয়া বলেন, “ইসলাম গণতন্ত্র ও প্রগতির বিরুদ্ধে নয়। সরকার আজ ইসলামে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যে কারণে মসজিদে ও মাদ্রাসায় তালা দিয়েছে। তিনি বলেন, নবীকে কটাক্ষকারীদের বিরুদ্ধে সরকার যদি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারতো তবে আজকে এতো সহিংসতা ঘটতো না।”

সরকারি ইন্ধনে শাহবাগের মতো বিশ্বে কোথাও কি আন্দোলন হয়েছে- এক দর্শকের এমন প্রশ্নের জবাবে আমু বলেন, “শাহবাগ নিয়ে জামায়াত-শিবির যড়যন্ত্র ও নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। যে কারণে শাহবাগের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”

নিরাপত্তা বিশ্লেষক আমিন আহমদ বলেন, “শাহবাগের আন্দোলন একটা নিম্নচাপ। এটা উত্তাল হলে ভিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। সুতরাং সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নিরাপত্তা দেয়া।”

পরে এক দর্শক প্রশ্ন করেন ‘প্রধান দুই দলের নেতারা দেশের সঙ্কট সমাধানের জন্য এক টেবিলে বসেন না কেন? এটা কোন সভ্যতার আচরণ?’

জবাবে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, “আমিও চাই প্রধান দুই দলের প্রধান দুই নেত্রী আলোচনায় বসুন।” একই মন্তব্য করেন আমির হোসেন আমুও।

অন্যান্য পাঠক মতামত বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর