সম্প্রতি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিরুদ্ধে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) নবায়নে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছে আদানি পাওয়ার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি একইসঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থ পরিশোধে জন্য ব্যর্থতার বিষয়টিও শক্তভাবে সামনে এনেছে। এতে করে ভবিষ্যতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে তৈরি হচ্ছে সংশয়।
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ার লিমিটেড (তৎকালীন এপি জে এল) ও বিপিডিবির মধ্যে স্বাক্ষরিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) ধারা ১৩.২(১) অনুযায়ী, বিপিডিবিকে নির্দিষ্ট সময় পরপর একটি বৈধ ও পর্যাপ্ত অঙ্কের এলসি নবায়ন করে রাখতে হবে। এই এলসি মূলত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে নিরাপত্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) স্পষ্ট শর্ত লঙ্ঘনের পরও কেন বিপিডিবি কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না—এই প্রশ্ন এখন ঘুরছে বিদ্যুৎ খাতের নীতিনির্ধারক মহলে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে চুক্তি স্থগিত বা আইনি বিরোধে গড়ানোর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পিডিবিকে দেওয়া চিঠিতে আদানি পাওয়ার লিখেছে, বারবার তাগাদা ও আনুষ্ঠানিক নোটিস দেওয়ার পরও বিপিডিবি এখনো এলসি নবায়ন করেনি, যা চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং একটি চলমান ‘ইভেন্ট অব ডিফল্ট’। এলসি নবায়ন না হওয়া শুধু চুক্তি লঙ্ঘন নয়, এটি তাদের আর্থিক ঋণদাতাদের আস্থা নষ্ট করছে এবং পিপিএ ও ইমপ্লিমেন্টেশন এগ্রিমেন্ট বাস্তবায়নে গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে।
পিডিবির চিঠি সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী বিপিডিবির দায়িত্ব ছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে একটি বৈধ ও পর্যাপ্ত অঙ্কের এলসি বজায় রাখা। এটি কোনো ঐচ্ছিক সুবিধা নয়, বরং বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের নূ্ন্যতম আর্থিক নিরাপত্তা। কিন্তু আদানি পাওয়ারের দাবি, গত ১৮ জুলাই থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাস ধরে সাত দফা চিঠি পাঠিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। চুক্তির ধারা ১৩.২(১) অনুযায়ী এলসি নবায়ন না হলে তা সরাসরি ধারা ৪.৩(গ) অনুযায়ী ‘ইভেন্ট অব ডিফল্ট’ হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ, আইনগতভাবে বিপিডিবি ইতোমধ্যেই চুক্তি ভঙ্গের অবস্থায় রয়েছে। চলতি বছর গত ১৩ নভেম্বর আদানি পাওয়ার বিপিডিবিকে আনুষ্ঠানিক ব্যর্থতার নোটিশ দেয়। বিষয়টি শুধু বিপিডিবিতেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, চুক্তির ধারা ৪.৬ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারকেও লিখিতভাবে অবহিত করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলসি নবায়ন না হওয়া মানে হলো সরকার কার্যত ঝুঁকি নিচ্ছে। এটি কোনো ছোট প্রশাসনিক ভুল নয়। এই এলসি জটিলতা বিপিডিবির গভীর আর্থিক সংকটের ইঙ্গিত বহন করে। ক্রমবর্ধমান ক্যাপাসিটি চার্জ, ডলার সংকট ও ভর্তুকি নির্ভরতা—সব মিলিয়ে বিপিডিবির আর্থিক ভারসাম্য নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
চিঠিতে আদানি পাওয়ার জানিয়েছে, তাদের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ঋণদাতারা বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিদ্যুৎ খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগে এলসি হচ্ছে সবচেয়ে মৌলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেটি অনিশ্চিত হলে প্রকল্পের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বিশ্লেষকদের মতে, এলসি ইস্যু দীর্ঘায়িত হলে আদানি পাওয়ারের সামনে কয়েকটি বিকল্প উঠে আসবে। এর মধ্যে রয়েছে চুক্তির অধীনে প্রতিকার দাবি, বিদ্যুৎ সরবরাহ সীমিত বা স্থগিত করা ও আন্তর্জাতিক সালিশি পর্যায়ে যাওয়া। যার প্রতিটিই বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। আদানি পাওয়ারের দাবি অনুযায়ী, বিপিডিবির দপ্তরে সাম্প্রতিক বৈঠকেও বিষয়টির জরুরি গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। কিন্তু বৈঠকের পরও কোনো লিখিত নিশ্চয়তা বা সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। এপিএল স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, অবিলম্বে এলসি নবায়ন করে লিখিতভাবে নিশ্চিত না করা হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমত পিডিবি চুক্তি ভঙ্গ করার মতো পর্যায়ে যাবে না, কারণ তার ফলাফল ভালো কিছু হবে না। তবে এটাও সত্য যে, পিডিবির পেমেন্ট করার মতো পুরোপুরি সক্ষমতা নেই।
তিনি বলেন, পিডিবি-আদানির ব্যাপারটা এখন অনেকটা ‘ঝগড়ার’ মতো হয়ে গেছে। ঝগড়া হলে মানুষ যেমনটা করে, পিডিবিও আদানির সঙ্গে তাই করছে। কারণ বিদ্যুতের দাম কমানো নিয়ে আদানির সঙ্গে পিডিবির দ্বন্দ্বটা চলছেই। তবে আদানিও বুঝতে পারছে, পিডিবির সেই আর্থিক সক্ষমতাটা নেই। মূলত, এলসি ইস্যুতে এখন দুই পক্ষেরই আলোচনা করে সমঝোতায় আসা উচিত এবং আশা করছি, পিডিবি এই বিষয়ে সমঝোতা করে ফেলবে।