রাজনৈতিক পালাবদলের পর যখন দেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার মেঘ, বিনিয়োগ স্থবির, ব্যাংক খাতে চাপ আর বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে দোলাচল। তখন অর্থনীতি টেনে তুলতে আশার আলো হয়ে বড় ভূমিকা রাখে প্রবাসী আয়। মাসে মাসে বিপুল রেমিট্যান্স আয়ে অবলম্বন খুঁজে পায় দেশের অর্থনীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অক্টোবর মাসে দেশে এসেছে ২৫৬ কোটি ২৪ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স।
আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। এই বিশাল অঙ্কের ৪২.৮১ শতাংশই এসেছে মাত্র তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে—ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সরকার পরিবর্তনের পর প্রবাসীদের মধ্যে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর আগ্রহ বেড়েছে। বাস্তবসম্মত বিনিময় হার, সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকা এবং হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি আবারও ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়েছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল রেমিট্যান্স সেবার বিস্তার ও ব্যাংক-এক্সচেঞ্জ হাউসের শক্তিশালী অংশীদারি, যা দূর দেশের ঘামঝরা আয়কে দ্রুত ও নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছে দেশে। এই প্রবাহের কেন্দ্রে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। দেশের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স সংগ্রহকারী ব্যাংক হিসেবে তাদের ভূমিকা যেন দীর্ঘদিনের চেনা গল্প—নীরবে, নিরবচ্ছিন্নভাবে। ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কামাল উদ্দিন জসিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রেমিট্যান্স সংগ্রহে ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকেই সক্রিয়।
বাহারাইন, ওমান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের লোকজন আছে। তারা শুধু কর্মী নয়, প্রতিষ্ঠানকে ভালোবেসে কাজ করে। বিদেশে থাকা আমাদের অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষিও ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকসংখ্যা আড়াই কোটির বেশি। এই গ্রাহকদের আত্মীয়-স্বজন যখনই বিদেশে যান, প্রথম পছন্দ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমেই টাকা পাঠান।
অন্য কিছু ভাবার আগেই আমাদের নাম আসে।’
সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংকের ভেতরের পরিবর্তনের কথাও উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। তিনি জানান, এস আলমের সময়ে নিয়োগ পাওয়া কিছু কর্মী পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ায় বাদ পড়েছেন। এর পর থেকে বর্তমান কর্মীরা দিনরাত আরো নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। এই ডেডিকেশনই আমাদের শক্তি। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা খুব ভালো। ২০২৬ সালের শেষে ইসলামী ব্যাংক সব দিক থেকেই আরো শক্ত অবস্থানে যাবে, এই আশা রাখেন তিনি।
অগ্রণী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকও এই রেমিট্যান্স সাফল্যের নীরব অংশীদার। রাষ্ট্রায়ত্ত এই দুই ব্যাংক প্রবাসী আয় সংগ্রহে দীর্ঘদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রেমিট্যান্স পৌঁছে দিতে সহায়ক হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যখন বিনিয়োগ, উৎপাদন ও রাজস্ব আদায়ে চাপ বাড়ছে, তখন রেমিট্যান্সই দেশের অর্থনীতিকে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে এই ইতিবাচক প্রবণতাকে টেকসই করতে হলে প্রবাসীদের আস্থা ধরে রাখা, সেবা আরো সহজ করা এবং রেমিট্যান্সকে উৎপাদনমুখী খাতে কাজে লাগানোর পথ খুলে দিতে হবে। নইলে এই একক আলোও একসময় ম্নান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে। ব্যাংকভিত্তিক হিসাবে অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ব্যাংকটির মাধ্যমে এসেছে ৫৯ কোটি ২৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি পেয়েছে ২৬ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার এবং তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২৪ কোটি দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স। নতুন করে রেমিট্যান্স সংগ্রহে শীর্ষদের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের নাম। মাত্র এক বছর আগেও ব্যাংকটির অবস্থান ছিল অনেক পরে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স প্রবাহের চিত্রও ইতিবাচক। এই সময়ে দেশে মোট প্রবাসী আয় এসেছে এক হাজার ১৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার বা ১৩.৫৫ শতাংশ বেশি। অর্থনৈতিক চাপ ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও এই প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।