প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থে কেবল সড়ক সেতু শীতকালে পদ্মাসেতুর নির্মাণ শুরুর আশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর

প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থে কেবল সড়ক সেতু শীতকালে পদ্মাসেতুর নির্মাণ শুরুর আশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর

বিদেশি অর্থায়নে সুবিধা না হলে নিজস্ব অর্থায়নে শুধুমাত্র সড়ক পথে গাড়ি চলাচলের জন্য পদ্মাসেতু নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

একই সঙ্গে শীতকালে পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরুরও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

বুধবার জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকার দলীয় সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলকের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, “পদ্মানদী অত্যন্ত খরস্রোতা। শীতকাল ছাড়া এখানে কাজ করা যাবে না। আমরা নদী ড্রেজিং ও নদীশাসন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’

তিনি বলেন, “আমাদের হাতে দুটি ডিজাইন রয়েছে। আমরা দেশে নতুন কিছু করতে চেয়েছিলাম। একটি ডবল ডেকার সেতু করতে চেয়েছিলাম, সেটির ওপর দিয়ে গাড়ি ও নিচ দিয়ে রেলপথে ট্রেন চলবে। আরেকটি শুধুমাত্র গাড়ি চলার জন্য। আমি সেতু বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। যদি অর্থায়নে অসুবিধা হয়, তাহলে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য প্রথমে গাড়ি চলাচলের জন্য সেতু নির্মাণ করবো।

প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, ‘‘আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারবো।’’

তিনি বলেন, “সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এ কাজ শেষ পর্যায়ে। বিশ্বব্যাংক এখাতে দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। অথচ যেখানে অর্থ ছাড়ই দেওয়া হয়নি, সেখানে দুর্নীতি খুঁজে পেলো।’’

বিশ্বব্যাংক প্রসঙ্গে সংসদনেতা আরো বলেন, ‘‘তারা নিজে থেকেই পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশাল অংকের টাকা সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে।”

বিশ্বব্যাংকের জন্যই পদ্মাসেতু নির্মাণে ‘কালক্ষেপণ’ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এর আগে চয়ন ইসলামের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “নিজস্ব অর্থায়নে আমাদের স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। যে প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য, ব্যয় সাশ্রয়মূলক ও দ্রুত হবে সেটাই গ্রহণ করা হবে। তবে পদ্মাসেতু নির্মাণকল্পে কোনো অর্থ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ছাড় করা হয়নি বলে বৈদেশিক ঋণের কোনো অর্থও ব্যবহার হয়নি।’’

তিনি আরো বলেন, “চলতি বছরের ১০ এপ্রিল পদ্মাসেতু নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ভিত্তিতে গত ২৭ আগস্ট মালয়েশিয়া সরকার কনসেশন চুক্তির খসড়া কপি সরবরাহ করেছে, যা যাচাই করা হচ্ছে।’’

‘‘নিজস্ব অর্থায়নে আমাদের স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে’’ যোগ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রকল্পের সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ঋণচুক্তিতে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে Integrity Advisor নিয়োগ করা হয়েছে।”

এর আগে একই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে মূল সেতুর টেন্ডার প্রক্রিয়ায় তা প্রমাণিত হয়নি। নির্মাণ তদারকি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ‘করাপশন কন্সপিরেসি’ বিষয়টি সম্পর্কে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’’

তিনি আরো বলেন, “বিশ্বব্যাংক মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণ চলার সময় চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে (সিআরসিসি) প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করার অনুরোধ জানায়। কিন্তু ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত মূল্যায়ন কমিটি সিআরসিসি’র দাখিল করা কাগজপত্র সঠিক না পাওয়া এবং এতে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত হবার পর ওই কোম্পানিকে প্রি-কোয়ালিফাইড না করার সুপারিশ করা হয়।’’

শেখ হাসিনা আরো বলেন, “তদন্ত চলাকালীন অবস্থায় শুধুমাত্র মূল সেতু এবং নির্মাণ তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বোর্ড সভায় কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন সংক্রান্ত ঋণচুক্তি বাতিল করেন, যা যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত হয়নি। এত বাংলাদেশের জনগণের বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু নির্মাণ কিছুটা হলেও পিছিয়েছে।’’

তিনি বলেন, “পদ্মাসেতু নির্মাণে কোনো অর্থই দাতা সংস্থাগুলো থেকে ছাড় করা হয়নি। এ কারণে বৈদেশিক ঋণের কোনো অর্থও ব্যবহার করা হয়নি। প্রকল্পটির প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়ন কাজে এডিবি’র সঙ্গে ২০০৭ এবং ২০০৯ সালে স্বাক্ষরিত ২৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের দু’টি কারিগরি ঋণচুক্তির অর্থ থেকে ২৬ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় ও ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদনে ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত তিন মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণচুক্তির বিপরীতে ১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় ও ব্যবহৃত হয়েছে।’’

এদিকে সম্পূরক প্রশ্নে ফজিলাতুনেসা বাপ্পি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এ খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফত রহমান কোকোর দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, কোকোর দুর্নীতির বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রচার করা হবে কিনা?

জবাবে প্রধানমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘আমাদের দেশে কিছু কিছু নেতা রয়েছেন, যারা বসন্তের কোকিলের মতো। কখন যে কুহু কুহু করে ওঠেন, কখন সরব হন, কখন নীরব হন, সেটা বুঝি না। তিনি যে হঠাৎ করে সরব হয়ে উঠলেন কেন, বুঝতে পারছি না।”

তিনি বলেন, “দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলেই দুর্নীতি ধরা পড়েছে। এটাতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ধরা পড়া উচিত ছিলো। তিনি (ড. কামাল হোসেন) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বড় উপদেষ্টা ছিলেন। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলো। ওই সময় কি কারণে দুর্নীতির বিষয়গুলো ধরা পড়েনি জানি না।’’

‘‘ভালো করে প্রচার করার জন্য যিনি বলেছেন তাকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করবো, তিনি নিজেই এটা ভালো করে প্রচার করবেন।’’ যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সরকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণপূর্বক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অগ্রাধিকারের মধ্যে প্রথমে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত সকল শ্রেণীর সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ। পরবর্তী অগ্রাধিকারে রয়েছে যথাক্রমে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ। শেষ ধাপে রয়েছে নতুন সড়কের জন্য গৃহীত নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন।’’

তিনি জানান, সড়ক বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ব্যবস্থাধীনে ২১ হাজার ৫৭১ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক হচ্ছে তিন হাজার ৫৭০ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক চার হাজার ৩২৩ কিলোমিটার এবং জেলা সড়ক ১৩ হাজার ৬৭৮ কিলোমিটার। এ সকল সড়কের বিভিন্ন স্থানে চার হাজার ৫০৭টি ব্রিজ, ১৩ হাজার ৭৫১টি কালভার্ট ও ৬০টি ফেরি সার্ভিস রয়েছে। প্রত্যাশিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অনুকূলে টেকসই, নিরাপদ ও মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো এবং সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে ২০ বছর মেয়াদী রোড মাস্টার প্ল্যান অনুমোদন করেছে সরকার।
তিনি জানান, ‘‘নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেও নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৬০ কিলোমিটার নৌ-রুট ড্রেজিং করা হয়েছে। এছাড়া ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদীতে ৩.৫০ কিলোমিটার নৌ-পথ ড্রেজিং করেছে।

গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিগত বছরগুলোতে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা অভিঘাত সত্ত্বেও রূপকল্পের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্য থেকে আমরা বিচ্যুত হইনি। পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে মাত্র তিন বছরে আমরা অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ প্রায় দ্বিগুণ করতে পেরেছি।”

পিনু খানের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “পর্যটন নগরী কক্সবাজারসহ পর্যটন সম্ভাবনাময় কক্সবাজারের মহেশখালী, উখিয়া, রামু, হোয়াইকং, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন এলাকার উন্নয়নে নগর উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে আগামী ২০ বছরের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। যার গেজেট নোটিফিকেশন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”

তিনি জানান, পর্যটকদের আবাসন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কক্সবাজারের কলাতলীতে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ৫৭৫টি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

মোল্যা জালার উদ্দিনের প্রশ্নের জবাবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাত দিয়ে সংসদ নেতা জানান, ‘‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিটিউর সার্ভে-২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন।’’

তিনি বলেন, “দারিদ্র্য নিরসনে আমাদের সরকারের সংগ্রাম আগের মতোই বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয় হলেও দারিদ্র্যের হার এখনো সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসেনি।”

তিনি বলেন, “বর্তমান সরকারের সময়কালে প্রতি বছর দারিদ্র্যের হার কমেছে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ হারে। এ হিসেবে ২০১২ সালে দারিদ্র্যের হার হবে ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ।”

তাজুল ইসলামের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “খাদ্য উৎপাদনে স্থায়ীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হলে ক্রমান্বয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য রফতানি করে দেশ বৈদেশিক মুদ্র অর্জন করতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভাবিত বাংলাদেশের কৃষি বিশেষত: অব্যাহত খাদ্য উৎপাদনের ধারাবাহিক সাফল্য, যে কোনো সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মেকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের মজুদ গড়ে তোলা এবং চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে আপাতত: খাদ্য (চাল) রফতানির পরিকল্পনা সরকারের নেই।’’

বাংলাদেশ