1. editor@priyodesh.com : editor : Mohammad Moniruzzaman Khan
  2. monirktc@yahoo.com : স্টাফ রিপোর্টার :
  3. priyodesh@priyodesh.com : priyodesh :
সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:২৫ পূর্বাহ্ন

পাইপলাইন নির্ভর জ্বালানি: বিশ্বসংকট আসন্ন!

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১২
  • ১৩৪ Time View

বলা হয়ে থাকে, হরমুজ প্রণালীর জন্যই ইরানের গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী। কারণ, পৃথিবীর মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ তেল এই প্রণালী দিয়ে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পৌছায়। প্রতিদিন কম করে হলেও ১৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেলের শিপমেন্ট হচ্ছে এ রুট দিয়ে। যা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের রপ্তানির শতকরা ৯০ শতাংশ বলে স্বীকৃত।

সম্প্রতি পারমাণবিক ইস্যুতে উত্তপ্ত হতে চলেছে ইরান। রাজনীতির রহস্যাবৃত এ চ্যাপ্টারে ক্রমশই যুক্ত হচ্ছে হরমুজের গুরুত্ব, যা বিশ্বব্যাপী পেট্রোডলারের রাজনীতিকে যে উসকে দেবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

কারণটাও স্পষ্ট, ইরাক দখলের নেওয়ার পর এখন ইরানের তেলসম্পদ দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠছে বিশ্ব মাতব্বরা। তাই যে কোনো ছুতোয় ইরানকে ধরো এমন মনোভাবেই এগুচ্ছে ওয়াশিংটনসহ মিত্রগোষ্ঠী।

মধ্যপাচ্য অস্থিতিশীল হলে সবচেয়ে লাভ হবে ইসরাইলের। ইসরাইল হচ্ছে মার্কিন প্রভুদেরও প্রভু। মুসলিম শক্তিধরদের মধ্যে ইরান বেশ গতিশীল। কারণ, ইরানের হাতে রয়েছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাস রিজার্ভ ও চতুর্থ বৃহত্তম প্রাকৃতিক তেল ভাণ্ডার।

তার উপরেও রয়েছে হরমুজ প্রণালী। তেলসম্পদসমৃদ্ধ পারস্য ভাস্কো-দ্য গামার আমল থেকেই পশ্চিমাদের কাছে লোভনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিতে পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে ওয়াশিংটনের কাছে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া মানে শ্বাসবন্ধ হয়ে মরার উপক্রম হওয়া। তাই ওয়াশিংটন যে কোন উপায়ে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া ঠেকাতে তৎপর রয়েছে।

সম্প্রতি ইরানের পার্লামেন্টে হরমুজ প্রণালী বন্ধের দাবি তুলেছে দেশটির পার্লামেন্ট মেম্বাররা। কিন্তু ইরানের আইনি কাঠামো জটিল হওয়ায় পার্লামেন্ট চাইলেই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে পারবে না। কারণ, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তুল্লাহ খামেনির হাতেই রয়েছে সর্বশেষ ক্ষমতা।

কেবল খামিনিই পারেন হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার বা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দিতে বা নিতে। তবে পালার্মেন্টে হরমুজ প্রণালী বন্ধের দাবিকে বিশ্লেষকরা দেখছেন অন্যভাবে। যদিও এ আলোচনাকে ডেমোভার্সন হিসেবে দেখা হচ্ছে তথাপিও এ আলোচনাই শেষ পর্যন্ত হরমুজের ভাগ্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে বলেও দেশটির স্পিকার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

ইরানের পরিক্ষীত বন্ধু চীন। ইরানের উৎপাদিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতাও চীন। হরমুজ প্রণালী  বন্ধ করে দেওয়া হলে এর আঁচ পড়বে চীনের উপরও। ইরানের তেলক্ষেত্রগুলোতে চীনের রয়েছে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। ইরানের প্রতিদিন উৎপাদিত ২ মিলিয়ন ব্যারেল তেলের গন্তব্য পথও এই হরমুজ। ইরানের সঙ্গে তেলের ব্যবসার কারণেই চীন শুরু থেকেই পারমাণবিক চুল্লি সম্পর্কিত আমেরিকার চোখরাঙানিকে বাড়াবাড়ি হিসেবেই দেখছে। তদুপরি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া হলে বিশ্বরাজনীতিতে পেট্রোডলারের ধস নামবে বলেও ওপেকের আশংকা।

তবে ওয়াশিংটনের অবস্থান শেষপর্যন্ত হরমুজের ভাগ্য নির্ধারণে ব্যর্থও হতে পারে বলেও আশংকা করা হচ্ছে। যদিও ওয়াশিংটন হরমুজ প্রণালী বন্ধের আশংকায় ভীত হয়েই বাহরানে পঞ্চম নৌবহরের পাহারা বসিয়েছে।

গেলবছর আমেরিকার আপত্তির মুখে ইরান থেকে তেল ক্রয়ে বিরত রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আমেরিকান অ্যালাইয়ের অধিকাংশ দেশ। যা ইরানের অর্থনীতিকে বেশ চাপে ফেলে দেয়।

তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, হরমুজের এক চতুর্থাংশও যদি ইরান বন্ধ করে দেয় তাহলে পৃথিবীব্যাপী তেলের দাম এক লাফে  ব্যারেল প্রতি ৫০ থেকে ১শ’ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

প্রাকৃতিকভাবেই হরমুজ পারস্য উপসাগরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২১ মাইল চওড়া এই প্রণালী দিয়ে পারস্য দেশগুলোর উৎপাদিত তেল ও গ্যাস যাচ্ছে চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে। ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাতের তেল রপ্তানি হচ্ছে এ পথ দিয়ে।

হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া হলে আমেরিকা ও ইউরোপ তেল আমদানির ক্ষেত্রে সৌদি আরব থেকে লৌহিত সাগর পর্যন্ত স্থাপিত পাইপ লাইনের বিকল্প পথ বেছে নেবে তাতে সন্দেহ নেই।

এছাড়াও সৌদি আরব ইউরোপীয় অঞ্চলে তেল সরবরাহের জন্য Iraq Pipeline in Saudi সংক্ষেপে IPSA কে বেছে নেবে।

ইরাক ১৯৮০ সালে ইরাক থেকে সৌদি আরব পর্যন্ত IPSA পাইপলাইন নির্মাণ করে। কিন্তু ১৯৯০ সালের ইরাকযুদ্ধে সৌদি আরব এ পথ  বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ সময় পর এ পাইপ লাইন এরইমধ্যেই খুলে দিয়েছে সৌদি আরব।

সম্প্রতি বেলজিয়ামে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পরই এ পাইপ লাইন খুলে দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সৌদি সরকার।

কিন্তু তারপরও কি হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব কমবে? যদি তাই হতো তাহলে হরমুজ প্রণালী নিয়ে আমেরিকা এতোটা উৎকণ্ঠিত হতো না।

হরমুজের বিকল্প পাইপ লাইন বেছে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী প্রতি ব্যারেল তেলে ১শ’ ডলার পর্যন্ত বেশি গোণা।

সৌদি তেল কোম্পানির মালিক ধনকুবের সা’দাত ইব্রাহীম আল হোসাইনের মতে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া মানেই বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া। কেননা এক ধাক্কায় তেলের দাম যদি আকাশছোঁয়া হয়ে যায় তাহলে তা গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেবে।

১৯৮৮ সালেও  হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। যা প্রায় ১ মাসব্যাপী চলে। সেবার আমেরিকার যুদ্ধ বিমানের মিসাইল লক্ষ্য ভুল করে ইরানের বেসামরিক এক প্যাসেঞ্জার বিমানকে আঘাত করলে ২৯০ জন বেসামরিক ইরানি জনগণ মারা যায়। এতে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। পরবর্তীতে আমেরিকা বাধ্য হয়েই ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সমঝোতায় পৌছে।

বিশ্বজুড়েই জ্বালানি নিয়ে চলছে পাইপ লাইনের রাজনীতি। ১৯৯৭ সালে অনেকটা আমেরিকার ইচ্ছেশক্তির বিরুদ্ধে ইরান ১১৯ মাইল দীর্ঘ গ্যাস লাইন তৈরি করে যা পূর্ব ইরানকে যুক্ত করে উত্তর-পূর্ব তুর্কিমেনিস্তানের সঙ্গে। ইরানের সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহে দু’টি প্রধান পাইপ লাইন Iran-Pakistan-India (IPI)  ও Turkeministan-Afganistan-Pakistan-India(TAPI) যা পাইপ লাইনে সংযুক্ত দেশগুলোর জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে।

এর বিপরীত স্রোতে ইরানকে পাশ কাটিয়ে কাসপিয়ান সাগরের তলদেশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নির্মাণ করছে তুর্কিমেনিস্তানের পাইপলাইন, যা ইরানকে এড়িয়ে সংযুক্ত হবে তুরস্ক পর্যন্ত।

সবদিক থেকে পাইপ লাইনের রাজনীতিতে অনেক দূর এগিয়ে আছে ভারত ও পাকিস্তান। এদিকে আমেরিকার রাশিয়া ভীতিও রয়েছে। কেননা মধ্য এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোকে বিদায়ে রাশিয়া সংকল্পবদ্ধ। তাই যুক্তরাষ্ট্র তেলসমৃদ্ধ ইরানকে যুদ্ধের ভয় দেখাচ্ছে নিজেদের আধিপত্য কায়েমের স্বার্থে। কিন্তুআমেরিকার মিত্র হলেও ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্তে ভারত বিপরীত মুখী অবস্থানে রয়েছে।

আমেরিকা জুড়েই হরমুজ বন্ধের মায়াকান্না শুরু হয়েছে। আন্তজার্তিক সমুদ্র আইনের দোহাই দিয়ে বিশ্ব সমর্থন আমেরিকার পক্ষের নেওয়ার কৌশলও এরইমধ্যেই পরিলক্ষিত।

যে করেই হোক, হরমুজ প্রণালীর পথকে মসৃণ রাখার জন্য আমেরিকা মরিয়া হয়ে উঠছে। আর এ লক্ষে আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এক হয়ে জাতিসংঘকে চাপ প্রয়োগ করছে। আর অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন ইরানের সরাসরি পক্ষ নেওয়ায় বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভারত আপাতত যে কোন পক্ষালম্বন থেকে বিরত থাকবে বলেই বিশ্বাস। কারণ, ভারত এখন ইরানের তেলের উপরই নির্ভরশীল।

বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া পেট্রোডলারের পুরানো চেহারা নতুন করে প্রকাশ হতে যাচ্ছে হরমুজ প্রণালীকে কেন্দ্র করে। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা না হলে পৃথিবীব্যাপী তেলের উচ্চ মূল্যের কারণে খাদ্যাভাব দেখা দেবে। যার ফলে দরিদ্র লোকের সংখ্যা আচমকাই বেড়ে যাবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এক হরমুজ প্রণালী পৃথিবীর অর্থনীতি ধসিয়ে দিতে পারে। যদি সত্যি সত্যি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে সামনের দিনগুলোতে  প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাসের অভাব দেখা দেবে গোটা বিশ্বজুড়ে। এমন কি ধনিক দেশগুলোও পর্যাপ্ত জ্বালানির অভাবে অভাবনীয় সমস্যায় পড়বে। বিষয়টি দিন দিন পরিষ্কার হচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© ২০২৫ প্রিয়দেশ