মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী আমিরুল হকের জেরা অব্যাহত রেখেছেন আসামিপক্ষ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-২ বৃহস্পতিবার তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কফিলউদ্দিন। আগামী রোববার পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে সাক্ষীর আগের দিনের জেরার রেকর্ড অন্তর্ভুক্তিকরণ সম্পর্কে আসামিপক্ষের ৪টি আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আগামী প্রথম সাক্ষী হিসেবে আমিরুল হক গত ১৫ জুলাই সাক্ষ্য দেন।
পরে জেরা করার সময় তিনটি বই সম্পর্কে প্রশ্ন করেন ও মতামত দেন অ্যাডভোকেট কফিলউদ্দিন। এর উত্তরে সাক্ষীর বক্তব্য নিয়ে ৩টি আবেদন করেন আসামিপক্ষ।
অন্য আবেদনটিতে আসামিপক্ষ অভিযোগ করেন, জেরার বিরতির আগে সাক্ষী একটি প্রশ্নের জবাবে এক কথা বলেন। কিন্তু বিরতির পরে প্রসিকিউশন শিখিয়ে দেওয়ায় অন্য কথা বলেন। ট্রাইব্যুনাল পরের জবাবটিই রেকর্ড করেন। আগের জবাবটি রেকর্ডের জন্য আবেদন জানান আসামিপক্ষ।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ২ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল শুনানি শেষে চারটি আবেদনই খারিজ করে দেন বৃহস্পতিবার।
গত ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাত ধরনের ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়।
ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরসহ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা কামারুজ্জামান। শেরপুর ডাকবাংলোয় বসে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সন্দেহভাজনসহ নিরীহ বাঙালিদের ধরে আনার নির্দেশ, হত্যা, নির্যাতন চালাতেন তিনি।
এছাড়া শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে তার পরিকল্পনা ও পরামর্শে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই ১২০ জন পুরুষকে হত্যা করা হয় এবং ওই গ্রামের প্রায় ১৭০ জন মহিলাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়। সে ঘটনার পর থেকে সোহাগপুর গ্রাম এখন ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত। এ কারণে সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর জন্যও দায়ী কামারুজ্জামান।
সব মিলিয়ে গণহত্যা, গণহত্যা সংঘটনে ষড়যন্ত্র, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যা, ব্যাপক নির্যাতনযজ্ঞ, দেশত্যাগে বাধ্য করা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে ক্রমাগত নির্যাতনের সুপিরিয়র হিসেবে সব অপরাধের একক ও যৌথ দায় কামারুজ্জামানের ওপর বর্তায় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগে।
২ জুলাই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৮১ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উত্থাপন করেন প্রসিকিউটর একেএম সাইফুল ইসলাম ও নুরজাহান বেগম মুক্তা।
সূচনা বক্তব্যে প্রসিকিউটররা কামারুজ্জামানকে ‘প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী’ বলে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালকে বলেন, তিনিসহ মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী, আশরাফ হোসেন, মোঃ শামসুল হক, মোঃ সাদত হোসাইন, আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মঈনউদ্দিন ও আব্দুস সালাম ছিলেন আলবদর বাহিনীকে পরিচালনা করতেন।
আলবদর বাহিনী গঠন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী (অক্সিলারি) ফোর্স হিসেবে এ বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও মানবতাবিরোধী নানা অপরাধেরও বিস্তারিত তুলে ধরা হয় সূচনা বক্তব্যে।
আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে রিভলভার, অটো মেশিনগান, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, গুলিসহ অস্ত্রসস্ত্র, প্রশিক্ষণ, রেশন ও মাসিক ৯০ টাকা ভাতা করে ভাতা পেতো। তারা প্রথমে কোর্তা-পায়জামা পরলেও পরে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আদলে খাকি পোশাক পরতো বলেও জানান প্রসিকিউটররা।
প্রসঙ্গত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত ৩১ জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এরপর গত ১৬ এপ্রিল প্রসিকিউশনের প্রধান গোলাম আরিফ টিপুর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের মামলাটি প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। গত ১৬ মে আসামিপক্ষ এবং ২০ মে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ করেন।