মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনালে নিজামীর বিরুদ্ধে এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
এ নিয়ে মোট যুদ্ধাপরাধের মামলায় মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন সম্পন্ন হলো। এর আগে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন সম্পন্ন হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট(সূচনা বক্তব্য) ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে ৫ জুন থেকে।
ট্রাইব্যুনাল-১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরের ওপেনিং স্টেটমেন্টের (সূচনা বক্তব্য) মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর দিন নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
নিজামীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
অপরদিকে ৬টি অভিযোগ এনে কাদের মোল্লার বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে আগামী ২০ জুন থেকে। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরের ওপেনিং স্টেটমেন্টের (সূচনা বক্তব্য) মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর দিন নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, পল্লবীর আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরানীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও খাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে হত্যার ঘটনা।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছর মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়।
পরে একই বছরের ২ আগস্টে ৫ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
গত ১১ ডিসেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এতে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
এ বিষয়ে প্রসিকিউশন ৩৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়।
গত ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এতে মোট ১৫টি অভিযোগ ছিল। অভিযোগ গঠনকালে বুদ্ধিজীবী হত্যা যোগ হয়েছে।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়।
২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লাসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গত বছরের ১ নভেম্বর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। ২৮ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১৬ এপ্রিল আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাসহ তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
মামলা স্থানান্তরের আগে গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। প্রসিকিউশন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে শুনানি শেষ করেছিল। আসামিপক্ষের শুনানিও শুরু হয়েছিল। তবে মামলা স্থানান্তরের কারণে ফের শুনানি নিয়ে অভিযোগ গঠন করলেন ট্রাইব্যুনাল-২।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করার পর এ পর্যন্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বর্তমান ৫ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির ২ নেতাসহ মোট ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একমাত্র বিএনপি নেতা আবদুল আলীম শর্তসাপেক্ষে জামিনে থাকলেও অন্যরা কারাগারে আটক আছেন।
এছাড়া মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-২ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি পালিয়ে দেশত্যাগ করেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং তদন্ত সংস্থা অগ্রগতি প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে।